Skip to content
Home » শিবনিবাস – নদীয়া

শিবনিবাস – নদীয়া

Share this in your social media

হৈমন্তীক প্রেমের গল্প

 

নভেম্বর 21, 2020
সেদিন যে টুক করে নদীয়া জেলায় শিবনিবাস থেকে ঘুরে এলাম, আসল উদ্দেশ্য কিন্তু শিবনিবাস ভ্রমন মোটেই ছিলো না। উদ্দ্যেশ্য ছিলো, ট্রেনে চেপে কু ঝিকঝিক করে দূরে কোথাও একটা যাবো, আবার ফিরে আসবো। করোনা রাক্ষসীর অভিশাপে, লোকাল ট্রেনের চাকা, সুদীর্ঘ বহু মাস থমকে থাকার পরে সদ্য সদ্য গড়াতে শুরু করেছে। লোকাল ট্রেন চলতে শুরু করার পর একদিন মাত্র (কালীপূজার দিন সন্ধ্যাবেলা) ট্রেনে চেপে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি আমি।
 
শিয়ালদা থেকে খড়দা, এই ছোট্ট ট্রেন যাত্রার সুখানুভুতি, শরীরে ও মনে যেই দুলুনি জাগিয়েছিলো, সেটা কিছুতেই স্থবির হচ্ছিলো না। সেই দুলুনি প্রশমিত করার একটা মাত্রই উপায়, আবার ট্রেনে চাপা। বাড়িতে বর্তমানে যেহেতু আমি একা, সকাল সকাল নিজেই গ্যাসে হাঁড়ি চাপিয়ে দুটো সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে, ঘি কাঁচালঙ্কা সহযোগে পেটে চালান করে, পুঁটুলিতে ছোলা গুড় বেঁধে (কেক, বিস্কুট, ছোট একটা জলের বোতল) ঘর ছেড়ে পথে নামলাম আমি ট্রেনে চাপবো বলে। আগের দিন রাতে ঘুমের মধ্যেই টের পেয়েছি বাইরে বেশ জোরেই বৃষ্টি হয়েছে। হেমন্তের এক বৃষ্টিভেজা মিষ্টি সকালে শুরু হলো আমার অন্যরকম পথ চলা।
 
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে প্রথমেই খড়দা স্টেশন। মনে মনে ঠিক করেছি, আপ শান্তিপুর, গেদে অথবা কৃষ্ণনগর লোকাল…যেটা আগে পাবো, উঠে পড়বো সেই ট্রেনেই। আজকে আমার পথে নামার আসল উদ্দেশ্য যে শুধুই ট্রেনে বসে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলা, আবার ফিরে আসা। যাই হোক, আপ গেদে লোকাল হলো সেই ভাগ্যবান ট্রেন, যে সুযোগ পেলো আমার পদধূলি প্রাপ্ত হয়ে নিজেকে ধন্য করার। ট্রেনের ঘোষণা হওয়া মাত্র ঝটপট টিকিট কেটে, ট্রেন স্টেশনে ঢুকবার অপেক্ষা করতে থাকলাম। ট্রেন স্টেশনে ঢোকামাত্র, সবার আগে এক লাফ মেরে সোজা লেডিস বগিতে, তারপর মুহূর্তের মধ্যে চোখ গোল গোল ঘুরিয়ে সবগুলো সিট সার্ভে করে, চোখের নিমেষে শরীরটাকে চালনা করে দিলাম জানলার ধারের সেই কাঙ্খিত আসনে।
 
 
ব্যাস, এটুকুই তো চেয়েছিলাম মনে মনে। ট্রেন কুঊঊ ঝিকঝিক করে এগিয়ে চললো তার গন্তব্যে, অর্থাৎ উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার খড়দা ছেড়ে নদীয়া জেলার গেদের পথে, আমাকে নিয়ে দুলতে দুলতে। রানাঘাট ছাড়ার পর থেকে, গেদে অবধি প্রকৃতি আরো নিবিড় ভাবে ধরা দেয় এই পথে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় সুয্যি মামার উপস্থিতি খুবই স্তিমিত। কেমন একটা মেঘলা অনুভূতি। আমি ঠান্ডায় জড়সড় হয়ে বসে, জানলার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ, সতেজ প্রকৃতির মোহময়ী রূপ। ভারী সুন্দর এই পথের স্টেশন গুলোর নাম। ভায়না, বগুলা, ময়ূরহাঁট, তারকনগর একে একে পার করে, এরপরে পার হয়ে গেলাম মাজদিয়া। ট্রেন এখন বানপুর ছাড়িয়ে হরিশ নগর হল্টের পথে। আর তার পরের স্টেশনটাই হলো এই পথের অন্তিম স্টেশন গেদে।
 
সব ঠিকই ছিলো, কিন্তু মাজদিয়া স্টেশন ছাড়তেই মনের মধ্যে “কুছ কুছ হোতা হ্যায়” টাইপ কিছু কিছু হতে লাগলো। অনেক আগে এক ভ্রমন ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম নদীয়াধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, এক কুখ্যাত ডাকাতকে দমন করতে এক জঙ্গলময় অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই অঞ্চলের আবহাওয়া মহারাজের এতটাই ভালো লেগেছিলো যে তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে একটি সুন্দর রাজপ্রাসাদ ও বেশ কয়েকটি সুউচ্চ শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন সেই সময়। এভাবে সেই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল হয়ে ওঠে শিবের নিবাস এবং লোকমুখে জায়গাটির নাম প্রচলিত হয়ে ওঠে ‘শিবনিবাস’ বলে। মাথাভাঙা, চূর্ণী এবং ইছামতি দিয়ে ঘিরে থাকা এই শিবনিবাসের পবিত্র মাটিকে মহারাজা এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে তার রাজত্বকালের একটি সময়ে, বর্গি আক্রমনের থেকে রক্ষা পেতে, তিনি কৃষ্ণনগর থেকে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন এই শিবনিবাসে।
 
এত সব কথা ভাবতে ভাবতে, বাইরে তাকিয়ে খেয়াল করলাম ট্রেন গেদে স্টেশনে ঢুকছে। গেদে স্টেশনে নামতে দেখি ডাউন গেদে রানাঘাট লোকাল 2 নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ট্রেনটি ছাড়তে আরো আধ ঘন্টা বাকী। একবার ভাবলাম এই আধ ঘন্টা সময়ে গেদে স্টেশনের খুব কাছেই ভারত আর বাংলাদেশের বর্ডার টা দেখে আসি। পরক্ষনেই মন বিদ্রোহ করে উঠলো যেই সীমারেখা একটি গোটা দেশকে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো করে, কি দরকার ঘটা করে সেই সীমারেখা দেখতে যাওয়ার….
 
 
তাছাড়া ওদিকে মনের ভেতর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী শিবনিবাস তোলপাড় করে চলেছে। অতএব বর্ডার অবধি না গিয়ে, গেদে স্টেশনের কাছেই একটি চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় গরম চা পান করে চেপে বসলাম ডাউন ট্রেনে, গন্তব্য মাজদিয়া স্টেশন এবং সেখান থেকে শিবনিবাস। মাজদিয়া স্টেশনে নেমে একটি টোটো ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম চূর্ণী নদীর তীরে।
 
 
হেমন্তের মেঘলা দিনে নিজ ছন্দে তিরতির করে বয়ে চলেছে পান্নারঙা মিষ্টি নদী চূর্ণি। নদীর ওপরে বাঁশ আর কাঠের তৈরী সেতু। পায়ে হেঁটে সেই সেতু পার করলেই ওই পারে শিবনিবাস। নদী পার হয়ে আম বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাবার সময়েই একটি মন্দিরের চূড়া দূর থেকে চোখে পড়লো।
 
 
 
আমবাগানের ভেতরে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে চোখে পড়লো এক পোড়ো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। কি জানি, এটাই কি তবে সেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদের ধ্বংস…..যাই হোক, মূল গল্পে আসি।
 
 
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই সময় অনেকগুলি মন্দির তৈরী করে থাকলেও বর্তমানে মাত্র তিনটি মন্দিরই অতীতের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে শিবনিবাসে। প্রথমে গেলাম রাজরাজেশ্বর মন্দিরে। প্রতিষ্ঠাকাল 1754 খ্রীষ্টাব্দ। ভেতরের শিবলিঙ্গটি 9 ফুট উঁচু। লোকশ্রুতি মহারাজ তার প্রথমা স্ত্রী রাজেশ্বরী দেবীর নামে মন্দিরটির এমন নামকরণ করেছিলেন।
 
 
 
এই মন্দিরটির পাশে রয়েছে রাম সীতা মন্দির। প্রতিষ্ঠাকাল 1762 খ্রীষ্টাব্দ। রামের মূর্তিটি কষ্টি পাথরের এবং সীতার মূর্তিটি অষ্ট ধাতুর তৈরী। রাম সীতা মন্দির ঘুরে সব শেষে এলাম রাজরাজ্ঞীশ্বর শিবমন্দিরে। এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা কাল ও 1762 খ্রীষ্টাব্দ। ভেতরের শিবলিঙ্গটি 7 ফুট উঁচু। জনশ্রুতি এই মন্দিরটি মহারাজ তার দ্বিতীয়া স্ত্রী রাজ্ঞীশ্বরী দেবীর জন্য তৈরী করেছিলেন বলেই মন্দিরটির এমন নামকরণ।
 
 
তিনটি মন্দিরই বাংলায় প্রচলিত মন্দির রীতিতে আলাদা স্থান করে নেয় তার নিজস্ব গঠন সৌষ্ঠবে। উচুঁ হওয়ার কারণে, দুইটি শিবলিঙ্গের পাশেই সিঁড়ি বানানো হয়েছে ভক্তদের সুবিধার্থে, যাতে দুধ জল ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো দিতে কোনো অসুবিধা না হয়। এমন ও জেনেছিলাম যে রাজরাজেশ্বর শিবলিঙ্গটি, স্থানীয়রা যাকে বুড়ো শিব বলে ডেকে থাকে, সেটি না কি বাংলা তথা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ।
 
 
 
মন্দির তিনটি ঘুরে এগিয়ে চললাম গ্রামের পথ ধরে। চোখে পড়লো দক্ষিনা কালী মন্দির। আরো কিছুটা এগিয়ে একটি গাছের ছায়ায় দেখলাম আরেকটি প্রাচীন মন্দির। ভেতরে গিয়ে দেবী মূর্তি দর্শন করে নাম জানলাম, ইনি দেবী শীতলা।
 
 
 
 
 
 
মন্দির ঘুরে এবার ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। চূর্ণির তীরে পৌঁছে মন চাইলো দু দণ্ড নদী তীরে, গাছের ছায়ায় বসি। এক জায়গায় দেখলাম, বুড়ো বট গাছের গোড়ায় কার্তিক ঠাকুর বসানো। কার্তিক সংক্রান্তিতে কার্তিক পুজোর শেষে গ্রামের লোকেরাই হয়ত এনাদের নদীর তীরে বটের ছায়ায় বসিয়ে রেখে গেছে। একলা কার্তিককে সঙ্গ দিতে আমি বসে পড়লাম তারই পাশে।
 
 
 
বাড়ি থেকে সঙ্গে করে আনা বিস্কুট কেক খেতে খেতে খেয়াল করলাম, স্থানীয় কিছু যুবক নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। পুঁটি মাছ ই উঠছে সব। খুব শিগগির আলাপ করে ফেললাম ওদের সঙ্গে, নিজেও নদীতে ছিপ ফেলে বসে রইলাম। নাঃ একটাও মাছ ওঠেনি আমার ছিপে। এবার সত্যি সত্যিই ফিরে যাওয়ার পালা। আবার সেই বাঁশের সেতু পায়ে হেঁটে পার হয়ে চেপে বসলাম টোটোতে।
 
 
মাজদিয়া থেকে শিবনিবাস আসতে, এই পথে মাথাভাঙা নদীসেতু পার হতে হয়। ড্রাইভার ভাইকে অনুরোধ করে টোটো দাঁড় করালাম মাথাভাঙ্গা সেতুর ওপর। গাড়ি থেকে নেমে আলাপ করলাম মাথাভাঙা নদীর সাথে। ড্রাইভার ভাই জানালো, তারকনগর এবং মাজদিয়া দুটি স্টেশনে নেমেই শিবনিবাস আসা যায়। মাজদিয়া দিয়ে আসলে মাথাভাঙ্গা নদী পার হতে হয়, আর তারকনগর দিয়ে আসলে পথে পড়ে ইছামতি নদী। আমার কাছে আগে যেহেতু এই তথ্য ছিলো না, তাই এই যাত্রায় আমার আর ইছামতির সঙ্গে আলাপ করা হয়ে উঠলো না।
 
 
মাজদিয়াকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি ট্রেনে উঠে বসলাম। জানলার বাইরে তখন দিনের শেষ প্রহর। সুয্যিটা গুটি গুটি পায়ে দিগন্তের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে রব। সমগ্র চরাচর সাদা কুয়াশার চাদরে নিজেকে ঢেকে নিচ্ছে একটু একটু করে।
 
 
বাতাসে কেমন একটা গা শিরশিরানি অনুভূতি। জানলার বাইরে হেমন্তের সন্ধ্যা একটু একটু করে রাতের অন্ধকারে ডুব দেয়, আর আমি রাতের সেই অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলি এক টুকরো আলোর সন্ধানে দিশেহারার মত……
5 1 vote
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: