পাহাড়ি রং, রিনচেনপং
১:
হোটেল Norlha ( 7872980787 ) তে ঢুকে যখন corridor দিয়ে একটি ছোট্ট মেয়ে আমাকে আমার রুম টা দেখিয়ে দিলো, তখনও বুঝিনি যে রিনচেনপং এর মার্চ মাসের ঠান্ডাও আমার হাড় হিম করে দিতে পারে। ঘরে ঢুকে দেখলাম সব বেশ পরিপাটি করে গোছানো। ছোট্ট মেয়েটি আধা হিন্দি আধা নেপালিতে বোঝাতে চেষ্টা করলো আমাকে যে আমার কিছু লাগলে যেন তাকে ডেকে নি।
আমি সম্মতি জানিয়ে তাকে বিদায় দিলাম। দরজাটা বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা ধোঁয়ার মত মেঘগুলো আমায় অভ্যর্থনা জানালো। আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি না রেখে, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নির্দ্বিধায় দেখলাম আমার বারান্দার খোলা দরজা আর তার পাশের জানালা দিয়ে দিব্যি আমার ঘরে অনাবিল প্রবেশ করে চলেছে। বেশ এক স্বপ্নময় পরিবেশ। বাইরের আলো ফিকে হয়ে এসেছে, কালো মেঘে ঢাকা চারিদিক। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝড়েই চলেছে। সুদূরের পাহাড় শৃঙ্গ গুলো আবছা ভাবে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। মেঘের ভেলাগুলো আমায় তাদের প্রত্যেক ছোঁয়াতে যেন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে যাচ্ছে, চল যাবো তোকে নিয়ে ওই দূর পাহাড়ের কোলে….!! মেঘের এই ভেলা থেকে অকস্মাৎ নেমে পড়তে হলো, যখন টের পেলাম আমার প্রায় দাঁত কপাটি লাগছে তখন। ঘরে ঢুকে আমার sweater এর ওপর মোটা কম্বল চাপিয়েও যেন ঠাণ্ডার কামড় আমায় ছাড়ছেনা ( এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমি কিন্তু মোটেই শীত কাতুরে নই…বরং ঠান্ডাটা আমি বরাবরই উপভোগ করি)। যাইহোক, সেই ছোট্ট মেয়েটির শরণাপন্ন হলাম। ওর থেকে গরম জল নিয়ে এসে ফ্রেশ হবার পরে অনেকটা ধাতস্থ হলাম। উপলব্ধি করলাম, বৃষ্টি ভেজা মার্চ মাসের পাহাড়কে কোনোভাবেই underestimate করা আমার ঠিক হয়নি।
২:
দার্জিলিং মেইল এ NJP নেমে সোজা চলে এসেছিলাম SNT বাস টার্মিনাস। ওখান থেকে জোড়থাং এর গাড়ি পেলাম। ঘন্টা আড়াই লাগে। জোড়থাং থেকে পেলাম রিনচেনপং এর গাড়ি। দু ঘন্টা চড়াই রাস্তা জোড়থাং থেকে। জোড়থাং এর উচ্চতা ১০৫৬ ফুট। আর রিনচেনপং ৫৫৭৬ ফুট। জোড়থাং থেকে এই অতিরিক্ত ৪৫২০ ফুট অতিক্রম করার যে রাস্তাটি, এর মধ্যেই দ্রুত পাল্টাতে থাকে আশপাশের পরিবেশ, আবহাওয়া, নির্জনতা আর মানুষগুলোর মন। দু ঘন্টার এই রাস্তা আপনাকেও তৈরী করে দেবে ওই মিষ্টি ছোট্ট গ্রামটার মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য। হ্যাঁ। ঠিক তাই। পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট মিষ্টি এই গ্রাম রিনচেনপং। যেমন মিষ্টি তার নাম, তেমনই মিষ্টি এই জায়গা। গুটি কয়েক হোটেল আর হোম স্টে তে ভরা রিনচেনপং। সহজ সরল মানুষে ভরা রিনচেনপং। মেঘেদের রাজ্যে এই রিনচেনপং। মেঘহীন আকাশে সুবৃস্তিত কাঞ্চনজঙ্ঘার উকিঁ দেওয়া এই রিনচেনপং। যাইহোক, আজ রাতটা শুধুই বারান্দায় বসে শান্ত, নিঝুম, বর্ষা স্নাত রিনচেনপং কে উপভোগ করার রাত। ইতি উতি কিছু গাড়ি চলাচল। লেন্সের লং এক্সপোজার এ সেই গাড়ির লাইট গুলোর ট্রেইল খুঁজে চলা। কান পেতে শোনা দূরে কোনো monastery থেকে মৃদু অথচ গম্ভির…ওম মনি পদ্মে হুম!! উপরি পাওয়া হলো আমার ঘরের load shedding! ঘরের ভেতর মোমবাতির আলো। বারান্দায় অমন নিঃশব্দ পাহাড়ের নানান ফিসফিস। জানালা কিছুটা খুললেই মোমের শিখা কাঁপিয়ে মেঘেদের জানান দিয়ে যাওয়া তাদের উপস্থিতি। রিনচেনপং এর প্রথম বিকেল আর সন্ধ্যেটা ঘর বন্দি হয়ে থেকেও, পাহাড়ের যা নির্যাস পাওয়ার তা আমি পেয়ে গেলাম এইসব অনুভূতির হাত ধরে।
৩:
আগের দিনের অতটা journey করে, ওরকম ঠান্ডায় লোমশ একটা কম্বলের নিচে যে কি সুখ নিদ্রা হতে পারে..তা বলাই বাহুল্য। যাইহোক, সকালে উঠে Mrs. Norlha কে বলতেই উনি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। একা হাতে হোটেল টি সামলান উনি। একটু গম্ভীর ঠিকই, তবে মমতাময়ী। ওনার হাতের গরম তিব্বতী চাওমিন খেয়ে রওনা দিলাম গাড়ি নিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই। বেশ কিছুক্ষন পাহাড়ি রাস্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা। প্রথমে গেলাম Rinchenpong Monastery তে। খুব ঝাঁ চকচকে না হলেও, প্রাচীনত্বের ছাপ আছে যেটা সবার মন কারবে। ইতি উতি ছড়িয়ে আছে লামাদের থাকার জায়গা। এখানকার বৌদ্ধ মূর্তি প্রথমেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এ এক অন্যরকম মূর্তি। বুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে আছে এক নগ্ন নারী শরীর।
গাড়ি Rinchenpong Monastery র কাছেই রেখে এবার একটু দম নিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম Reesume Monaster র পথে। Reesume হলো রিনচেনপং এর সর্বোচ্চ স্পট। ৩০০ বছরের পুরোনো এই monastery. ১.৫ কিমি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই রাস্তা। সরু এই রাস্তা দিয়ে ৪০০ সিঁড়ি উঠছে গেছে monastery অব্দি। উর্ধ মুখে তাকালে যেন মনে হয় প্রত্যেক পরতে পরতে কোনো এক নতুন অজানা রহস্য অপেক্ষা করে আছে এই পথে।পুরো রাস্তাটা পাখির কুজন শুনতে শুনতে আর হিমেল হওয়ার ছোঁয়া নিয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম। ওপরে উঠে যেন এক অন্য জগৎ। সবুজ গালিচার মধ্যে বহু পুরোনো এই monastery. মেঘেদের আনাগোনার মধ্যে যেন এক স্বপ্নপুরী। Monastery র দরজায় একটি বড় জীর্ণ তালা ঝোলানো।পরে জেনেছিলাম এই তালা নাকি বছরে শুধু একবারই খোলা হয় সিকিমের কোনো এক উৎসবে। অনাদরে পরে আছে এই প্রাচীন monastery. তা সত্ত্বেও উঠলে যেন আর নামতে ইচ্ছে করেনা। কোনো এক আদিম তিব্বতী সভ্যতার আবেশে বেশ কিছুক্ষন বুঁদ হয়ে থেকে নেমে এলাম গাড়ির কাছে।
এরপর এসে পৌঁছলাম poison lake. স্থানীয় ভাষায় বিখ – পোখরি নামে পরিচিত। কেউ কেউ বলে ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য নাকি এই পুরো জলাশয় টাকে বিষাক্ত করে তুলেছিল লেপচা রা। আবার কেউ বলে এক ব্রিটিশ অফিসিয়াল এর বাংলোর সাথে যুক্ত ছিল এই জলাশয়। তাঁকে হত্যার জন্যই লেপচারা এই জলাশয় কে বিষাক্ত করে তোলে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে এই জলাশয় আজও বিষাক্ত। তবে আজ এই জলাশয় জল আর নেই বললেই চলে…শুকিয়ে গেছে। এর কিছুটা দূরেই আছে ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো। আমি অবশ্য সেটা বন্ধই পেলাম।
গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললাম একটি লেপচা গ্রামে। লেপচা দের বাড়ির ধরণ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। এরকমই এক লেপচা বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম ক্যামেরা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে। আমার ড্রাইভারের বারণ সত্ত্বেও। সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি বাড়িটার। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি এক পুরুষ সোজা আমার দিকে এগিয়ে এলো। পরিষ্কার ইংরেজি তে বললো চোখ মুখ পাকিয়ে “Who gave you the permission to enter here?” লেপচারা যে মোটেই বন্ধুত্ব পরায়ণ নয়, ইটা আগেও পড়েছিলাম আমি কোথাও। বেশি কথা না বাড়িয়ে তাকে বোঝালাম যে আমি শুধু বাইরে থেকেই কিছু ছবি নেব। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে, সেও আর কথা বাড়ালো না।
গাড়ি ছুটে চললো কালুকের পথে। কালুকের কালী মন্দিরে বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠে দেবীর থান। ওপর থেকে কালুকের গ্রামটার একটা bird’s eye view পাওয়া যায়।
এগিয়ে চললাম আমার পরের গন্তব্যের দিকে… Sinshore Bridge. এটি এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় উচ্চতম সাসপেনশন ব্রিজ এবং ভারতের সর্বোচ্চ hanging bridge হিসেবে পরিচিত। দুই দিকের দুই পাহাড়কে জুড়ে রেখেছে এই সিনশর ব্রিজ। অসাধারণ এক স্থাপত্য, ঝুলন্ত, দোদুল্যমান। গাড়ি এপারে রেখে হেঁটে ব্রিজের মাঝামাঝি চলে এলাম। দুপাশের হিমেল হাওয়া জাপটে ধরলো আমাকে। পা থমকে গেল হঠাৎ। সামনের পাহাড়গুলো যেন দুলছে। তবে কি ভুমিকম্প? দুপাশে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই সেদিকের পাহাড়গুলোও দুলছে। কড়া একটা গাড়ির হর্ন শুনে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বুঝলাম ব্রিজের ওপর গাড়ি চলে আসাতে ঝুলন্ত এই ব্রিজ দুলতে শুরু করেছে। পাহাড় নয়, দুলছি আমি। ব্রিজের পাশের রেলিং গুলোতে ঝোলানো রং বেরঙের তিব্বতী পতাকা। হিমেল হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদী, রঙ্গীত। এই জায়গাটা ডেন্টাম ভ্যালি নামে পরিচিত। Dentam cheese উৎপাদনের জন্য খ্যাত। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে রঙ্গীতের বয়ে চলা। ব্রিজের ওপারে ১২ কিমি গেলে আপনি ঢুকে যাবেন পশ্চিম সিকিমের আরেক নয়নাভিরাম গ্রামে, নাম তার উত্তরে।
যে পথে সিনশর ব্রিজ এলাম, সেই পথেই ফেরার পথে একটু এগিয়েই পেলাম Hee Water Garden. হি খোলা এবং রঙ্গীতের প্রবাহকে ভিত্তি করে বানানো এই পার্ক। ভেতরে ঢুকে দেখি সবুজের সমারহ। খুব সুন্দর সাজানো এই পার্ক। হাতে আঁকা ছবির মতন। স্থানীয় মানুষজনের আমোদ প্রমোদের জায়গা এই Hee Water Garden. ভেতরে একটি সুইমিং পুল ও আছে। সুইমিং পুল এর সামনেই উচুঁ পাহাড় থেকে বয়ে আসা রঙ্গীত।
পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেগে থাকা মৌমাছির বাসা। পার্কের মাঝামাঝি একটি প্রকান্ড Buddhist Wheel. তাতে বৌদ্ধ মন্ত্র খচিত। এই wheel ঘোরানো তে পুন্য পাওয়া যায়, এটাই বিশ্বাস তাঁদের।
এবার রিনচেনপং ফেরার পালা। পথে পেলাম সিরিজুঙ্গা দূর্গা মন্দির। তার সামনেই দেখি স্থানীয় কিছু মহিলারা নেপালি ভাষায় নাচ গান করছেন। পথ আটকে। ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে একটি হেলথ কেয়ার সেন্টার এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান চলছে।
স্থানীয় MLA সাহেব নিজেও উপস্থিত, তাই আপাতত রাস্তা ব্লক করে অনুষ্ঠান। অগত্যা আমাকেও অপেক্ষা করতে হলো। তবে ১০ মিনিটের মধ্যেই রাস্তা খুলে গেল। রিনচেনপং পৌঁছে আমার হোটেল কে ডান হাতে রেখে আরো কিছুটা এগোতেই পেলাম Gurung Gumpha. বেশ সাজানো গোছানো এই নতুন গড়ে ওঠা gumpha টি।
এই গুমফার পেছনের রাস্তা দিয়ে মিনিট ১০এক হেঁটে পৌঁছে গেলাম Rabindra Smriti Van. কবিগুরুর স্মৃতিতে এই রবীন্দ্র বন।
মেঘেদের কৃপায় এতটা পথ বৃষ্টির খুব একটা চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয়নি। তবে এইবার আবার সেই কালো মেঘের ঘনঘটা। অতএব হোটেলের নিরাপদ আশ্রয় ফেরা।
৪:
হয়তো কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার দেখা হলো না। কিন্তু পাহাড়ে বৃষ্টির অভিজ্ঞতাও আমার কাছে এক অনন্য পাওনা। মেঘেদের মাঝে থেকে জল রঙে আঁকা রিংচেংপং এর এই রং মনে মেখেই পরদিন নেমে এলাম পাহাড় থেকে সমতলে। কথা দিয়ে এলাম Mrs. Norlha কে , আবার দেখা হবে!!
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
Very good!!