Skip to content
Home » গাং পেরিয়ে গেঁওখালী

গাং পেরিয়ে গেঁওখালী

Share this in your social media

 

১:

 মঙ্গলবার অফিস থেকে ফিরেই দেখি বাড়ির সামনের রাস্তায় খনন কাজ শুরু হয়েছে। গাড়ি বের করার কোনো উপায় নেই। একরাশ বিরক্তি গ্রাস করে বসলো। মে মাসের শেষ শনিবার , ২৭ তারিখ। পরিকল্পনা ছিল শুক্রবার রাত্রেই গাড়ি নিয়ে কোথাও একটা বেরিয়ে পড়বো। পূর্ব পরিকল্পনাও করিনি কোনো। এখন এত তাড়াতাড়ি ট্রেনের টিকিট ও পাওয়া যাবেনা। বিষন্নতার কালো মেঘে হাবুডুবু খেতে খেতে গুগলের শরণাপন্ন হলাম। গেঁওখালী জায়গাটির সংক্ষেপ বিবরণ টা মনে ধরলো। ব্যাস, এটুকুনি যথেষ্ট। এইবারের অভিযান গেঁওখালী।

২:

শনিবার সকাল সকাল বেরিয়ে ধর্মতলা থেকে উঠে পড়লাম নুরপুরের বাসে। ৫৫ কিমি রাস্তা নুরপুর। তারপর ওইখান থেকে নৌকো করে ওপারে গেঁওখালী। এইটাই সবথেকে শীঘ্রতম রুট গেঁওখালী পৌঁছানোর। মোটামোটি আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম নুরপুর। নেমে হাঁটা লাগালাম ফেরি ঘাটের দিকে। বেশ লাগছিলো সারী দিয়ে দাঁড় করানো বড় বড় নৌকাগুলো দেখতে নদীর পাশে। নৌকো বানানোর কারখানা এটি। ফেরিঘাট পৌঁছেই দেখি লঞ্চ ছাড়ার তোড়জোড় করছে। 

Krishnachura tree at Nurpur Ferry Ghat

Krishnachura tree at Nurpur Ferry Ghat

Ferry ghat at Nurpur

Nurpur Ferry Ghat

কিন্তু ঘাট থেকে লঞ্চে ওঠার পদ্ধতিটা দেখে আমার পিলে চমকে গেল। প্রায় ৭-৮ ফুট লম্বা একটি পাতলা কাঠের পাটাতন ফেলা আছে ঘাট থেকে একেবারে লঞ্চ অব্দি, চওড়ায় ১ ফুট হবে। তার ওপর দিয়েই লোকজন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে লঞ্চে উঠছে। পা ফসকালে সোজা জলে। পাড়ের দিকে কাদামাটির জন্য নৌকো ঘাট অব্দি আসতে পারে না, তাই এই ব্যবস্থা। আমার আগে দু একটি মহিলাকে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে এই পাটাতন অভিযানটি সাফল্যের সঙ্গে সাঙ্গ করতে দেখে, এখন আমি মনে বল পেলাম। সাহস সঞ্চয় করে পা বাড়ালাম এবং কোনো অঘটন না ঘটিয়ে লঞ্চে উঠতে অবশেষে স্বার্থক হলাম। 

Geokhali launch boarding

This is how you have to board the launch at Nurpur Ghat

৩:

লঞ্চে বসার জায়গা থাকলেও আপাতত আমার বসার কোনো ইচ্ছে নেই। দিগন্ত ব্যাপী জলরাশি চারিদিকে, যেদিকেই দুচোখ যায়। নদী এখানে ভয়ঙ্কর রকমের চওড়া। নদী বলা ভুল। এ হলো ত্রিবেণী সঙ্গম। গঙ্গা, দামোদর আর রূপনারায়ন….এই তিন নদীর সঙ্গম হলো গেঁওখালী। মাঝামাঝি এসে মনে হলো যেন সমুদ্রে এসে পড়েছি। দূরে দেখা যাচ্ছে বড় একটি জাহাজ, পতাকা দেখে মনে হলো জাপানের। অনেকটা দূরে থাকা সত্ত্বেও সেই বিশালকায় জাহাজের ঢেউয়ের তরঙ্গে আমাদের লঞ্চটিও দুলে উঠলো।

Tribeni Sangam

Tribeni Sangam

মিনিট পঁচিশেক লাগলো গেঁওখালী পৌঁছতে। নেমে একটু এগোতেই একটি সাইকেল ভ্যান পেয়ে গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গম রিসোর্টে যাওয়ার জন্য। নদীর পার দিয়েই রাস্তাটা। মেঘের আনাগোনায় রোদের তেজ এখন তুলনামূলকভাবে কম। নদীর পারে চোখে পড়ছে বেশ কিছু ডুবে থাকা ভগ্নপ্রায় বাড়িঘর। ভ্যান ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করায় বললো, প্রত্যেক বছর নদী গ্রাস করছে গেওখালীকে একটু একটু করে। পাড় ভাঙতে ভাঙতে এখন নদী ঘর বাড়ি গুলোকেও গ্রাস করছে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গম রিসোর্টে। একেবারে নদীর পারে রাস্তার ওপরেই এই রিসোর্ট, অতুলনীয় অবস্থানটি।

৪:

Haldia Tourism and Industrial Development এর নিজস্ব প্রপার্টি এই ত্রিবেণী সঙ্গম রিসোর্ট। 

Tribeni Sangam Resort

Tribeni Sangam Resort

জায়গাটির গুরুত্বের সাথে তাল মিলিয়েই এই নামটি। বুকিং আগেই ফোনে করে রেখেছিলাম ওনাদের নিজস্ব ওয়েব সাইট থেকে ( http://haldiatourism.gov.in/triveni_sangam.html ). তুলনামূলকভাবে খালি থাকায় আমি দোতলায় এসি রুম টাই পেয়ে গেলাম। বারান্দা থেকে উন্মুক্ত উত্তাল ত্রিবেণী সঙ্গমের বুকে একের পর এক বড় বড় আন্তর্জাতিক জাহাজের আনাগোনা দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলাম কোথায় যেন। 

Big cargo ship at Geokhali

Big cargo ship at Geokhali

Geokhali view from balcony

View from the balcony of Triveni Sangam Resort

চশমার কাঁচে বৃষ্টির ছাট আসায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ভেতরে এসে লাঞ্চ এর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচে ডাইনিং হলে চলে এলাম। এইখানে একটা কথা না বলে পারছি না। বহু হোটেলে থেকেছি, তবে এনাদের মত এত আদর আপ্যায়ন করে খাওয়ানো খুব কমই দেখেছি। বড্ড আপন মনে হলো সব কিছু আর তেমনি সুস্বাদু খাবার।

৫:

বিকেলে একটি টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মহিষাদল রাজবাড়ির দিকে। শ্বেত শুভ্র ফুলবাগ নামে পরিচিত প্রাসাদ প্রমান  রাজবাড়িটা আজও অক্ষত। পড়ন্ত বেলার মিঠে আলোয় সবুজ গালিচার ওপর অসাধারণ সুন্দর এই রাজবাড়ি।

Mahishadal Rajbari

Mahishadal Rajbari

Compound of Mahishadal Rajbari

Compound of Mahishadal Rajbari

সম্রাট আকবরের সেনা বিভাগের এক উচ্চপদে ছিলেন জনার্দন উপাধ্যায়। পরে তিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে এই  গেঁওখালীতে এসে উপস্থিত হন এবং তৎকালীন জমিদার কল্যাণ  রায়চৌধুরীর থেকে জমিদারি কিনে নেন। উপাধ্যায় বংশের পঞ্চম পুরুষ ছিলেন আনন্দলাল উপাধ্যায়। আনন্দলাল এবং জানকী দেবীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাই আনন্দলাল গত হওয়ার পর জানকী দেবী ওনাদের দৌহিত্র, গুরুপ্রসাদ গর্গ কে সমস্ত রাজ্যপাট দান করেন। তখন থেকে এই গর্গ রাই রাজবংশের উত্তরাধিকারী। রাজবাড়ির একাংশে আজও বসবাস করেন রাজপরিবারের কিছু সদস্যরা। রাজপরিবারের ব্যবহৃত পোশাক আশাক, অস্ত্র শস্ত্র এবং আসবাবপত্র ঘুরে ঘুরে দেখলাম। রাজবাড়ির সামনেই একটি কামান। দূর প্রান্তের সারী সারী তালগাছের ফাঁক দিয়ে আসা বিকেলের সোনালী আলো গায়ে মেখে পুরো রাজবাড়ির চত্বরটি যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা একটি রূপকথার গল্প তখন।

Cannon of Mahishadal Rajbari

The cannon of Mahishadal Rajbari

Sunset at Geokhali

Sunset at Geokhali

 

 কিছুটা এগিয়েই চোখে পড়লো ভগ্নপ্রায় পুরোনো রাজবাড়িটি এবং সেই রাজবাড়ির চত্বরে একটি মন্দির।

Gate of old Mahishadal Rajbari

Gate of old Mahishadal Rajbari

Old Mahishadal Rajbari

Old Mahishadal Rajbari

রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি আমার অটো ওয়ালা ভাইটি খুবই উৎসুক এলাকার একটি মন্দিরে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যদিও আমার ট্যুর প্ল্যানিং এ এটি ছিলো না, তবুও অটো ওয়ালার উৎসাহের সাথে কিছুটা তাল মিলিয়েই চলে এলাম কৈলাশ নাথের মন্দির। মন্দিরের বাইরে একটি হোর্ডিং চোখে পড়লো “প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ দ্বারা শুভ বিবাহের ব্যবস্থা আছে”। “প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ” যে ঠিক কি প্রকারের ব্রাহ্মণ তা বোধগম্য হলো না। যাইহোক, ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম খুব সুন্দর সাজানো মন্দিরটি। বিষ্ণু, শিব এবং নরসিংহ দেবের দর্শন সেরে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।

Geokhali Mahishadal Kailash Nath temple

Kailash Nath temple

Lord Vishnu at Kailash Nath Temple

Lord Vishnu on boat at Kailash Nath Temple

Mahishadal Kailash Nath temple Nrisinghadev

Idol of Nara Sinha deb at Kailash Nath Temple

৬:

গভীর রাত অব্দি অনেকটা সময় কেটে গেল বারান্দায় বসে ত্রিবেণী সঙ্গমের রাতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। গেঁওখালীর এই শান্ত নিরীবিলি পরিবেশ আর তার সাথে ১৬শ শতাব্দীর ইতিহাসের ছোঁয়া নিয়ে বেশ কেটে গেল উইক এন্ডটা। তবে মনে একটা ভয় রয়েই গেল। নদীর পার যেভাবে ভাঙ্গতে শুরু করেছে ক্রমাগত শীঘ্রই সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নিলে, জানিনা অদূর ভবিষ্যতে এই গেঁওখালীকে আর ফিরে পাবো কিনা।

0 0 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: