Skip to content
Home » গিরিডি অভিযান

গিরিডি অভিযান

Usri fall at Giridih tour plan
Share this in your social media

স্মৃতিচারণ

সাল টা সম্ভবত ১৯৯৬। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক|  সেই প্রথম উশ্রীর সাথে সামনাসামনি পরিচয়। আজও মনে পরে তিন বন্ধুতে জমিয়ে আড্ডা মেরেছিলাম উশ্রীর সাথে একটি পুরো দিন। “ঘোর বর্ষাতে জলপ্রপাতের মজাই অন্যরকম। সপ্তাহান্তে গিরিডির কাছে উশ্রী ফলস দেখতে গেলে হয়না?” – আগস্টের শেষ সপ্তাহে লীনার এই প্রশ্ন উস্কে দিলো আমার ২০ বছর আগেকার স্মৃতি। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম মনের মনিকোঠায় সযত্নে রাখা উশ্রীকে পুনরায় দেখতে পাবো বলে। দলের অন্য দুজন সদস্য, বিদিশা এবং স্নেহাংশু ও তাদের সম্মতি জানালো। ফেসবুকের পাতায় দীর্ঘ কয়েক বছরের বড় কাছের বন্ধু – শুভজিৎ দত্ত এবং বিশ্বরূপ মান্না। উভয়পক্ষেরই ইচ্ছে পোষণ হচ্ছিলো বেশ কিছুদিন যাবৎ যে একসাথে সবাই মিলে কোনো এক সুদূরে আমাদের ঘুরণচন্ডি মনগুলোকে নিয়ে ডানা মেলে উড়তে। ফেসবুকের পাতা থেকে উঠে এসে সেই অভিপ্রায় এইবার সত্যিই বাস্তবায়িত হল।

কোলকাতা থেকে গিরিডি

সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার। কোলকাতা স্টেশন থেকে কোলকাতা-পাটনা স্লিপ এক্সপ্রেস ছাড়ার সময় সন্ধ্যা ৭.৫০ মিনিটে। এই ট্রেনটিতে গিরিডি যাওয়ার জন্য ১-২টি বগি আসলে হাতবদল হয়ে যায় অন্য ট্রেনের সাথে মধুপুর থেকে। বাকি ট্রেনটি পাটনা বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। অফিসের কাজকর্ম মিটিয়ে স্নেহাংশু, বিদিশা, লীনা এবং আমি উবের ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। অনেক্ষন ওয়েটিং এ রেখে তবে উদয় হলো আমাদের উবের। নেভিগেটর দেখে কিছুক্ষণ পর লীনা আঁতকে উঠে বললো “এতো একদম মার্জিনাল টাইম…৭.৪০ এ ঢুকবো দেখাচ্ছে। ও ড্রাইভার জী উড়াকে লে চলিয়ে জলদি হুমলগো কো!” শুনে ড্রাইভারজীর ভাবলেশহীন উত্তর -“আপ জো ভি বলতে রাহিয়েগা, মে আপনা হিসাব সে হি চালাউঙ্গা।”

কোলকাতার রাস্তায় অফিস টাইম এর যানজট যেকোন কিছুর হিসেব যখন খুশি ওলট পালট করে ফেলতে পারে, একথা সকলেরই জানা। টেনশন হবার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি! ড্রাইভার এর সাথে কিসব ফিসফিসিয়ে স্নেহাংশুর ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতিষীর মতো দৈববাণী – “টেনশন বিলকুল মত লো। পাতা হে তুমলগো কো গাড়ি কৌন চালা রাহা হে? খুদ ভাগোয়ান জী হাম লোগো কো লেকে যা রাহা হে।” আসলে ড্রাইভার জীর নাম ভাগোয়ান দাস! যাইহোক শ্যামবাজার পাঁচ মাথার শেষ ভয়ঙ্কর সিগন্যালটা থেকে ছাড়া পেয়ে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ট্রেন ছাড়ার মিনিট কুড়ি আগেই স্টেশনে পৌঁছলাম। শুভজিৎ ও বিশ্বজিৎ আগেই পৌঁছে গেছিলো। দিনের শেষ সিগারেটটা খেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে উঠলাম ইঞ্জিনের একেবারে পাশের বগিটিতে, S1. ৬ জন থাকাতে একটা কুপ পুরো পেয়ে গেছিলাম। আলাপ চারিতা, গল্প আড্ডা, শুভজিতের আনা মালপোয়া আর রুটি তর্কার সাথে জমিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা।

স্লিপ এক্সপ্রেস নির্দিষ্ট সময়ের থেকে প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট স্লিপ করে আমাদের নিয়ে গিরিডি ঢুকলো সকাল ৬টা নাগাদ। ছোট্ট একটি রং চোটে যাওয়া স্টেশন তবে বাইরে পা দিতেই আমাদেরকে উশ্রীর রঙে রাঙানোর জন্য একেক করে এগিয়ে আসতে থাকলো অটো এবং চার চাকার সারথীরা।

Giridih station

Giridih station

সূর্যোদয় টা ফসকে যাওয়াতে সবাই ঠিক করলাম আপাতত আগে ধর্মশালা বা হোটেলের খোঁজ করা যাক। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে ২-৩ মিনিট হাঁটলেই মোদী ভবন বা ধর্মশালা। ১০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকার বিভিন্ন আয়তনের ঘর আছে বটে কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না, পাশের ট্রান্সফরমার উড়ে যাওয়াতে মোদী ভবনে আজ আর কারেন্ট আসার সম্ভাবনা নেই।

Giridih hotel searching

Searching for hotel at Giridih

একটু খুঁজে কাছেই পেয়ে গেলাম কাবেরী হোটেল। ৫৫০/- টাকা রুম পিছু দিয়ে দুটো ঘর নিলাম আমরা। ফ্রেশ হয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেরিয়ে চলে এলাম একটি মিষ্টির দোকানে। কচুরী আলুর তরকারির সাথে প্ল্যানিং চললো আগে উশ্রী না আগে খান্ডলি। “খান্ডলি তে তো লেক আছে, ওটাই বরং বিকেলের দিকে রাখি।” – লীনার এই প্রস্তাবটা সকলেরই মনঃপুত হলো।

গিরিডি শহর

স্টেশন, ধর্মশালা, খাবার দোকান, বাজার, অটো স্ট্যান্ড, গাড়ি স্ট্যান্ড…সবই প্রায় গায়ে গা লাগানো। দেখলে মনে হয় পুরো গিরিডিটাই যেন ১ কিমি এ শেষ! জলখাবার সেরে বেরোতেই খান তিনেক অটো ওয়ালা আমাদের ছেঁকে ধরলো। এদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছেলেটির নাম কাদের আলম। বেশ চটপটে, সঙ্গে আবার তার অ্যাসিস্ট্যান্ট সতিন্দর সিং। উশ্রী যাওয়া আসা, যতক্ষন খুশি ওখানে থাকা এবং যথেচ্ছ ছবি তোলা…এসব নিয়ে ৩০০/- টাকায় রফা হল আলম জুটির সাথে। এখানে অটো মানে বিক্রম, সামনে দুজন, মাঝে ৩ জন এবং পেছনে ৪ জন অনায়াসেই বসতে পারে। যাত্রা শুরু হল উশ্রীর উদ্দেশ্যে। গাড়ি গড়াতেই স্নেহাংশুর দাবী – “ভাইয়া পেহলে বরিয়া সা কই চায় কে দুকান পে রাখনা।” চা তেষ্টা অবশ্য আমাদের সকলেরই পেয়েছিল। কাদের আলম হাই ওয়ে ধরে কিছুটা অটো ছুটিয়ে একটি চায়ের দোকানে গাড়ি থামালো। ঘন দুধের পরিমান এতটাই বেশি, এক চুমুক দিয়েই আমি বুঝলাম সে জিনিস আমার জন্য নয়।

Giridih chaiwala

Chaiwala

উশ্রির সুশ্রী

গিরিডি থেকে উশ্রী ১৩ কিমি রাস্তা। দুপাশে ঘন সবুজের মাঝে চকচকে কালো পিচের রাস্তা। এ রাস্তার সঙ্গে আমার ২০ বছর আগের কাঁচা এবড়োখেবড়ো চড়াই উতরাই রাস্তা যেখানে আমাদের সমেত আমাদের অটোটি উল্টেছিল এবং আমরা তিন বন্ধু অল্পের জন্য বেঁচে গেছিলাম, তার কোনো মিল নেই। বুঝলাম আজকের উশ্রী এক নবরূপে আমার সামনে ধরা দেবে যার সাথে আমার ফেলে রেখে আসা উশ্রীর অনেকটাই অমিল। দুপাশের ছোটখাটো জঙ্গল পার করে দিগন্তে দৃষ্টি মেললেই ধরা পড়ছে ছোটনাগপুর মালভূমির বৈশিষ্ঠ।

Giridih to Usri

Our auto…on way to Usri fall

মিনিট ৪০ লাগলো পৌঁছাতে উশ্রীর ( Usri  Waterfalls) একেবারে মুখের সামনে। ডানদিকে ধাপ ধাপ করা পাথর সোজা নেমে গেছে উশ্রী নদীর বুকে। বাঁ দিকে সিমেন্ট বাঁধানো একটি জায়গা যার থেকে উশ্রীর মূল জলপ্রপাতটির দূরত্ব ২০ ফুট মত হবে। এখানে দাঁড়ালে আগ্রাসী উশ্রীর জলের ধোঁয়া আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। আমরা একে একে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম উশ্রী নদীর কোলে। বর্ষায় উশ্রী এখন পূর্ণ যৌবনা। গর্জন করে আছড়ে পড়ছে সে পাথরের বুকে। উশ্রীর বৈশিষ্ঠ উচ্চতায় নয়, বরং তার ব্যাপ্তিতে। অনেকটা চওড়া পাথর মালার ওপর থেকে জলরাশি নেমে এসে উশ্রী নদীতে মিশেছে।

Usri fall at Giridih tour plan

Beautiful Usri waterfalls

বেশিরভাগ পাথরের পৃষ্টতল সমতল হওয়ার ফলে এক পাথর থেকে অপর পাথরে অনায়াসেই হেঁটে চলে যাওয়া যায় একেবারে নিচ অবধি। পেছন দিক দিয়ে ঘুরে জলপ্রপাতের একেবারে ওপরেও পৌঁছানো যায়। সূর্য একেবারে মধ্য গগনে, এই ঠাটা পোড়া রৌদ্রে কি ছবি হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহগ্রস্ত আমি আর স্নেহাংশু। স্নেহাংশু শুয়ে বসে বিভিন্ন রকম এঙ্গেলে ক্যামেরা বন্দী করে চলেছে উশ্রীকে। লীনা উশ্রী নদীর জল পায়ে ঠেকাবে বলে গুটি গুটি পায়ে পাথর বেয়ে অনেকটা নিচে নেমে উপর থেকে আদিবাসী এক টহলদারের ধমক খেয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে আবার ফিরে এসেছে।

Giridih tour plan Usri rocks

Rocks at Usri falls

Giridih tour plan Usri tribal people

Tribal people guarding the Usri fall

বিশ্বরূপ নদীর ধারের ঝোপঝাড়ে বিভিন্ন প্রকার প্রজাপতি পেয়ে তাদের পেছনে ক্যামেরা বাগিয়ে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে। শুভজিৎ হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে উশ্রী নদী বয়ে কোনদিকে গিয়ে মিশেছে, সেই রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যস্ত। বিদিশা অটোতে করে আসা মেকআপ এর ফাইনাল টাচ টার রক্ষারতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে খুঁজে চলেছে কিছুটা ছায়া। আর আমি? কখনো এ পাথরে কখনো ও পাথরে ট্রাইপড এ ক্যামেরা গেঁথে অ্যাপারচার শাটার স্পীড নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছি। মধ্যে কথা হল সবাই নিজের মতো করে উশ্রীর সাথে আলাপচারিতা সেরে নিচ্ছে।

৬:

রৌদ্রের প্রখর তাপ আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বাতাসের আর্দ্রতা আমাদের ঘন্টা দেড়েকের বেশি উশ্রীর সাথে মিশতে দিলো না। উপরে উঠে এসে দেখা পেলাম এক আদিবাসী খরগোশ শিকারীর সাথে। “কাদের আলম” এতক্ষনে “আমাদের আলম” হয়ে গিয়ে জমিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে গেছে আমাদের সাথে।

Giridih tour plan Usri rabbit hunter

Rabbit hunters at Usri

বিশ্বরূপ একেবারে স্নান সেরে ওপরে এলো একটু পরে। হোটেলে ফেরার পথে আমাদের সাথের দুই ম্যাডামের হঠাৎ একটু ইচ্ছে হলো রাস্তার মাঝখানে বসে একটু মডেল ফোটোগ্রাফি করবেন। তাঁদেরকে নিরাশ না করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁদের মনোবাঞ্চনা পূর্ণ করে তবে হোটেলে ফিরলাম। আলম কে বলে রাখলাম যে বিকেলে তার সাথেই আমরা খান্ডলি ড্যাম ঘুরতে যাবো। স্নান পর্ব সেরে আড্ডায় জমে গিয়ে ঠিক হলো একেবারে ৩.৩০ টা নাগাদ বেরিয়ে লেট লাঞ্চ করে আমরা বেরিয়ে পড়বো খান্ডলির উদ্দেশ্যে। সত্যি বলতে কি কাল সন্ধ্যা থেকে পরপর ঘটনা প্রবাহ যেভাবে এগিয়েছে, নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প করার সুযোগ সেভাবে আসেনি। বিশেষ করে মান্না আর দত্ত আমাদের দলে একেবারে নতুন সদস্য। দু আড়াই ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা দিয়েই বুঝলাম ছেলে দুটি একেবারে আমাদের মনের মতো, একই সুরে বাঁধা আমরা ছয়টি প্রাণ। পরিকল্পনা মাফিক ৩.৩০ টায় বেরিয়ে লাঞ্চ সেরে সতিন্দর কে ফোন করতেই কিছুক্ষনের মধ্যেই গোঁ গোঁ শব্দ করে আলম বীর বিক্রমে তার বিক্রম নিয়ে হাজির।

খান্ডলি ড্যাম

রওনা দিলাম খান্ডলির পথে। এই রাস্তা উশ্রীর একেবারে বিপরীত দিকে। প্রায় ১৪ কিমি রাস্তা। ১০ মিনিট পরেই শহুরে নাগাল ছাড়িয়ে আশপাশের দৃশ্যপট একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো। দু পাশে মালভূমি, সবুজে মোড়া গালিচা, ছোট ছোট পাথুরে টিলা আর লাল মাটির রাস্তা বড় রাস্তা ছেড়ে মাঝে মাঝেই দূরের গভীর জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। দূর্দান্ত এই রাস্তা।

Giridih tour plan plateau

Plateau region of Giridih

মন টা বেশ চাঙ্গা হয়ে গেল। আমাদের উত্তেজনার ছোঁয়া কাদের আলমের গায়েও কিভাবে লাগলো বুঝলাম না, তবে সে হঠাৎ দেখি তার বিক্রমকে দ্বিগুন গতিতে ভিডিও গেমসের গাড়ির ন্যায় এঁকেবেঁকে ছোটাতে লাগলো! পেছন থেকে কে জানি বলে উঠলো, “জলীয় পদার্থ খেলো কে, আর তার প্রক্রিয়া হলো কার ওপর!” সে যাইহোক, আমরা মনোনিবেশ করলাম রাস্তার ওপর। বেশ কিছু জায়গায় দাঁড় করলাম আলম কে, ছবি নেওয়ার জন্য। এহেন রাস্তা দেখলে সপ্তপদীর উত্তম সুচিত্রা কে মনে পড়তে বাধ্য।

Giridih to Khandoli road

Road to Khandoli Dam from Giridih

গানের চয়েসের ব্যাপারে লীনা এবং মান্না বেশ পারদর্শী। যাত্রার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তারা ঠিক “এই শহর থেকে অনেক দূরে…” দিয়ে শুরু করে “এই পথ যদি না শেষ হয়…” তে চলে এসেছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে অটো দাঁড় করালাম। বাঁ পাশ দিয়ে সবুজের বুক চিরে চলে গেছে লাল মাটির রাস্তা মালভূমি বেয়ে ছোট ছোট টিলার পেছনে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে “আমরা করবো জয়…”- গাইতে গাইতে লীনা দিলো এক ছুট সেই রাঙা মাটির রাস্তা ধরে। স্থানীয় এক দেহাতি বৃদ্ধ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

Giridih old villageman

The old village man on his cycle

লীনার বাংলা গান তাঁর বোঝার কথা নয়। তার ওপর অমন দুহাত ডানা মেলে ধেয়ে যাওয়া। ভদ্রলোক একটিবার শুধু পেছন ফিরে লীনাকে দেখলেন, তারপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দ্বিগুন বেগে প্যাডেল চালিয়ে সোজা পগার পার হয়ে গেলাম। আমরা পুনরায় রওনা দিলাম খান্ডলির পথে।

খান্ডলি যখন ঢুকলাম তখন প্রায় ৪.৪৫। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। বোটিং এর ব্যবস্থা আছে। আমরা নিলাম ৬ সিটের একটি প্যাডেল বোট। ড্যামের প্রায় মাঝামাঝি একটি লাল ঝান্ডা পোতা আছে, সেই অবধি গিয়ে বোট ঘুরিয়ে আনতে হবে। বিকেলের চুরি যাওয়া আলোয় ছয় মূর্তিমান ভেসে পড়লাম খান্ডলি হ্রদের জলে। একপাশে ঘিরে আছে স্বল্প উচ্চতার পাহাড় সারি।

Khandoli dam lake at Giridih

Khandoli dam lake

অন্যদিকে হাতছানি রহস্যময় জঙ্গলের। সূর্যাস্তের শেষ রেশটুকু নিয়ে আমরা পারে ফিরলাম। পাশেই আছে একটি পার্ক। যাঁরা বাচ্ছাদের নিয়ে যাবেন তাঁরা পার্কে অনায়াসেই বেশ কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। বোটিং কমপ্লেক্সটির পাশের ক্যাফে থেকে চা খেয়ে আমরা ফেরার পথে রওনা দিলাম। দিনের শেষ আলোর রেখাটি বিদায় নিয়েছে কিছুক্ষন আগেই।

Khandoli dam sunset at Giridih tour plan

Sunset at Khandoli dam

রাওনা দিলাম হোটেলের পথে। হোটেলে ফিরে দুপুরে যেখানে ছেড়ে গেছিলাম, সেখান থেকেই শুরু করা হলো সান্ধ্য আড্ডা। গানে, কবিতায়, আড্ডায় আর নিজ নিজ প্রতিভার বিকীরণে মশগুল হয়ে রইলাম ছয়টি প্রাণ। কাবেরী হোটেলে খাবার ব্যাবস্থা নেই তাই পরোটা আর তর্কা নিয়ে আসা হলো বাইরে থেকে। পরের দিনের ভ্রমণের একটি খসড়া মাথায় সাজিয়ে ইতি টানলাম আজকের মতো।

মধুবন

আজ গিরিডিতে আমাদের দ্বিতীয় দিন। সকাল সকাল উঠে তৈরী হয়ে একেবারে চেকআউট করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। জলখাবারে গতকালের সেই মিষ্টির দোকানের কচুরী আর গুলাব জামুন। ঘড়িতে তখন প্রায় ৯.৩০। মধুবন এবং তোপচাচি, এই দুইটি আজ আমাদের মেনুতে। তোপচাচি প্রায় ৬৫ কিমি আর মধুবন বা পরেশনাথ ৩০ কিমি। অর্থাত আজ আর অটো নয়, চার চাকা দরকার। গাড়ির খোঁজ করতেই গতকাল স্টেশনে নামার পর যে সারথীরা ছেঁকে ধরেছিল, তাদেরই মধ্যে মধ্য বয়স্ক একজন হাসি মুখে এগিয়ে এলেন তার মারুতি অম্নি নিয়ে। ১৮০০ টাকায় রফা হলো সারাদিন ঘুরে বেড়াবার জন্য। গিরিডি মোড় থেকে একটু এগিয়েই চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ানো হলো।

Giridih city tea stall

Tea stall

এই প্রথম জমাটি একটা চা পেলাম গিরিডিতে। সত্যিই মন প্রাণ তাজা হয়ে গেলো। শুরু হলো যাত্রা NH 2 ধরে। সদ্য নির্মিত পুলিশ লাইন পার করেই একটু পরে বরাকর নদীর ওপর সেতু। বালিয়াড়ি আর ইতস্ততঃ ছড়ানো পাথুরে নদী তটে বরাকরের স্মিত চুম্বন উপর থেকে বড়ই নয়নাভিরাম। কিছু ছবি নিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম।

Barakar river at Giridih

Barakar river

Giridih childen selling vegetables

Children selling vegetables beside the road

যত এগোচ্ছি ঝাড়খন্ডিও আদিমতা ও ঘন সবুজ বন্যতার পরশ আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। তার সাথে তাল মেলাচ্ছে ছোট ছোট আদিবাসী কয়েক ঘর গ্রাম, জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা গাছের ডালের ঝাঁকি মাথায় নিয়ে আদিবাসী নারীর দল আর পথের ধারে নিজস্ব বাগানের শশা বা করলা সাজিয়ে নিয়ে বসা শিশুর দল। দেখতে দেখতে বাঁ দিকে একটি বাঁক নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম মধুবন। পরেশনাথ পাহাড়ের একেবারে কোলে এই মধুবন, জৈনদের অন্যতম তীর্থস্থান। বেশ ঝাঁ চকচকে চারিদিক। দিগম্বর স্বেতাম্বর দের ভিড়ে কোথাও কোথাও এখনও উকিঁ দিচ্ছে স্থানীয় দারিদ্রের ছায়া।

Paresnath temple at Giridih tour plan

Paresnath temple at Madhuban

মধুবনে গাড়ি রেখে আমরা এগোলাম পাহাড়ের পথে। গায়ে গা লাগানো অজস্র জৈন মন্দির, দোকান পাট আর ডুলি বাহকদের হাঁক -“ডোলি লিজিয়ে গা, বাবু?” এখানে বলে রাখি পরেশনাথ পাহাড়ে গাড়ি ওঠে না, হেঁটেই উঠতে হয়। ওঠা নামা নিয়ে প্রায় ২৭ কিমি রাস্তা, মোটামোটি ১২ ঘন্টা লেগে যায়। যাঁদের হেঁটে ওঠার ক্ষমতা নেই, তাঁরা ডুলি ভাড়া নেন। একেকটি ডুলি কম করে ৪৫০০/- টাকা নেয়। ওজন বেশি হলে অর্থের পরিমাণও বাড়বে। এছাড়াও পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে অন্য একটি কাঁচা রাস্তা উঠে গেছে যেটা শুনলাম নাকি বাইকের যাওয়ার রাস্তা। বাইক ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তবে আজকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নাকি বাইক ওঠা বন্ধ রাখা হয়েছে। এযাত্রায় সেই অভিপ্রায় আমাদের নেই কারণ সময়ে কুলাবে না।

তবে পাহাড়ের কোলে পৌঁছে পাহাড়ী পাহাড়ের ঘ্রান না নিয়ে তো ফেরা যায় না। বিশ্বরূপ, আমি আর লীনা উঠতে থাকলাম চড়াই রাস্তা ধরে। ঘন সবুজের ছায়ায় মোড়া কংক্রিটের রাস্তা পাকদন্ডী দিয়ে উঠে গেছে একেবারে ওপরে। ধর্মের বৈশিষ্ঠ তো আছেই, তবে সেটি ছাড়াও এই পর্বতারোহণ তার নিজস্ব প্রাকৃতিক মহিমায় দাগ কেটে যাবে সকলের মনে। প্রায় ২ কিমি আপন খেয়ালে আমরা উঠলাম। পথে দেখা হলো বেশ কিছু ভক্তগনের সাথে যাঁরা দর্শন সেরে এখন নামার পথে, কেউ বা পদব্রজে লাঠি হাতে…কেউ বা রক্ত মাংসের আট পায়ীর কাঁধে ভর করে!

Giridih tour plan Paresnath hill

Duli at Paresnath Hill

কিছু ছবি নিয়ে নামতে থাকলাম। শেষ ৫০০ মিটারে একটি বাঁকের মাথায় দেখি আমাদের দলের বাকি ৩ মক্কেল রাস্তায় শুয়ে বসে বিভিন্ন মুদ্রায় কার যেন ছবি তুলে চলেছে। একটি বাঁদর! ডারউইনের বিবর্তন নীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মহাশয় তখন কদলী ভক্ষণ ছেড়ে গোগ্রাসে parle-g মুখে পুরে যাচ্ছেন একের পর এক।

Paresnath hill monkey

Monkey having biscuits at Paresnath hill

Paresnath hill monkey feeding

Monkey taking the biscuit from Senhangsu

 

তোপচাচি

নিচে নেমে আরেক খেপ চা খেয়ে রওনা হলাম তোপচাচির পথে। রেলের লেভেল ক্রসিং এড়ানোর জন্য ড্রাইভার সাহেব NH 2 ছেড়ে কিছুটা পথ বাইপাস ধরে টানলেন। যত এগোই দুপাশের সবুজ ততই যেন গাঢ় হয়। দুপাশের ঘন বনানীর ওপর দিয়ে চোখ চলে যায় দূরে নীলচে পাহাড়ের পর্বতমালায়।

Giridih tour plan Topchachi journey

Journey to Topchachi

তোপচাচি অভয়ারণ্যর সামনাসামনি যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৩ টার কাছাকাছি। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা আর রৌদ্রের তাপ, দুইই চরমে। আর তার সাথে আমাদের খিদেও। কাছেই একটি ধাবায় লাঞ্চ সেরে গাড়ি নিয়ে গেট পারমিট করে ঢুকে পড়লাম অভয়ারণ্যে। বনকর্মীর কড়া নির্দেশ গাড়ি পুলের মুখ অবধিই নেওয়া যাবে, বাকিটা আমাদের পদব্রজেই ঘুরতে হবে। পুল অবধি রাস্তাটা দুপাশে বট অশ্বথ গেছে ছেয়ে আছে। বটের ঝুড়ি নেমে এসেছে প্রায় রাস্তা অবধি।

Giridih tour plan Topchachi dam

Entry point of Topchachi Dam pool

Giridih tour plan Topchachi lake

Topchachi lake with the shadow of the hills

পুলের মুখে নেমেই এক মায়াবী পৃথিবী যেন ধরা দিলো আমাদের সামনে। তোপচাচির সুবিশাল জলাশয় ঘিরে আছে ছোট বড় পাহাড়ের সারি আর সুগভীর অরণ্য। হ্রদের জলে তারই প্রতিবিম্ব, যেন পাহাড় এসে মিশেছে অতল জলের গভীরে। নিঝুম নিস্তব্ধ আর এক প্রশান্তি চারিপাশে। ড্যাম এর পুল বা ব্রিজ টি বাঁ দিকে, ডান দিকেও চলে গেছে একটি রাস্তা। হ্রদের ওপর প্রান্তে ঘন অরণ্য গিয়ে মিশেছে পাহাড়ে।

Topchachi forest on Giridih tour plan

View of Topchachi forest from above the dam

দুপাশের রাস্তা দিয়েই সুবিশাল জলাশয়টি চক্কর মারা যায়। আমরা পুল পেরিয়ে বাঁ দিকে হাঁটা লাগালাম। রাস্তা ছাড়িয়ে মাঝে মাঝেই কাঁচা পথ ঘাসের গালিচা বেয়ে নেমে গেছে একেবারে হ্রদের জলে। গাছের ছায়ায় বসারও জায়গা করা আছে কিছুটা দূরে দূরে। হ্রদের কোলে সবুজ গালিচায় বেশ কিছুক্ষণ গা এলিয়ে অস্তগামী সূর্যের অবস্থান বুঝে আমরা ঠিক করলাম এদিকে আর বেশি না এগিয়ে বরং পুলের ওপাশের রাস্তাটা ধরে এগোনোই শ্রেয়। বেলা প্রায় ৪.৩০ তখন। ওপাশের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে মনের মতো একটি জায়গা চোখে পড়লো যেখান থেকে সূর্যাস্তের ছবি মনোমত পাওয়ার সম্ভাব্যনা সব থেকে বেশি। ট্রাইপড নামিয়ে হ্রদের পাশে এখানেই ঘাঁটি গাড়লাম সকলে।

Sunset at Topchachi

Sunset at Topchachi lake

 

আকাশে বাষ্পের পরিমান অতিরিক্ত থাকাতে কিছুটা অধরা রয়ে গেলো আজকের সূর্যাস্ত। তবে যা পেলাম তাও কম নয়। এক মোহময়ী মায়াবী পরিবেশে বিদায়ী সূর্যের রক্তিম ছায়া তখন হ্রদের জলে। ওপাশের পাহাড় শ্রেণী এখন আরও গাঢ় নীল। চারিপাশে আওয়াজ বলতে শুধু মাত্র নীড় মুখী পাখিদের কলতান। অথবা গরুর পাল নিয়ে বাড়ির পথে ফেরা দেশওয়ালি মহিলার “হুইইই। হুট হুট।”

Giridih tour plan Topchachi localites

Village women returning with the cows at Topchachi

অস্তগামী সূর্যের শেষ বিন্দু অবধি আমরা মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে আটকে রইলাম ওই মায়ার জগতে। বনকর্মীর তাড়া খেয়ে ড্রাইভার গাড়ি সমেত আমাদের খোঁজে এগিয়ে আমাদের আবিষ্কার করে ফেলায় অবশেষে উঠতে হলো। মান্না আর দত্ত আরেকটু এগিয়ে গিয়ে একটা স্পটে বসেছিল।

Giridih tour plan Topchachi lake blue hour

Blue hour at Topchachi lake

ফোনে ওদের ডেকে নিয়ে পুলের দিকে এগোলাম। পুলের মুখে একটি চায়ের দোকান। তার পাশ দিয়ে পাথুরে সিঁড়ি উঠে গেছে ওয়াচ টাওয়ারে। লীনা একাই বেয়ে বেয়ে উঠে গেল সে পথে। চা শেষ করে বেরোতে বেরোতে অন্ধকার নেমে এলো। গেট অবধি রাস্তাটি তখন গরুর পালে ভর্তি। হেড লাইটের জোরালো আলো আর হর্ণে পথভ্রষ্ট হয়ে আমাদের পথ করে দিলো তারা। স্নেহাংশুকে অফিসের কাজে বেরিয়ে যেতে হবে ধানবাদ। অভয়ারণ্য ছাড়িয়ে ১ কিমি মতো গেলে তোপচাচি মোড়। সেখান থেকে ধানবাদের অটো এবং বাস পাওয়া যায়। ওকে বিদায় জানিয়ে বাকি পাঁচজন আমরা ফিরতি পথে রাওনা দিলাম গিরিডির দিকে। গিরিডি যখন ঢুকলাম তখন সবে রাত ৮ টা। ট্রেন আমাদের ১০.১০ এ।

বিদায় গিরিডি

সারাদিনের ধকলের পর সকলেরই একটু ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন। ঘন্টা দুয়েকের জন্য মোদী ভবন ধর্মশালায় একটি ফোর বেডের রুম পেয়ে গেলাম ২৫০/- টাকায় দরাদরি করে। ট্রান্সফরমার মেরামত হয়ে আজ বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিকঠাক সেখানে। পরোটা তর্কা প্যাক করে নিয়ে ঠিক ১০ টায় আমরা স্টেশনে ঢুকে গেলাম। ট্রেন এলো একটু দেরিতেই। দুদিনের অসংখ্য কিছু ভালো লাগার মুহূর্তের ছবি গতিমান ট্রেনটির খোলা জানালা দিয়ে ঢোকা হাওয়ার সাথে আমাদের চোখে, মুখে আর মনে ঝাপটা দিয়ে গেলো। কতই না এমন আদিম বন্য ঐশ্বর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ রাজ্যে!!

 

5 1 vote
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: