Skip to content
Home » রেশম পথের তুষার অভিযান

রেশম পথের তুষার অভিযান

Share this in your social media

১:

এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা এই তিন মহাদেশকে ছুঁয়ে প্রায় ৬৫০০ কিমি বিস্তৃত রেশম পথ বা সিল্ক রুট বা সিল্ক রোড। প্রাচীনকালে তখনকার তিব্বত থেকে এই পথেই রেশম পৌঁছে দেওয়া হতো ইউরোপে। তার থেকেই এই নাম। তিব্বতের লাসা থেকে শুরু করে চুম্বি ভ্যালি এবং নাথুলা পাস অতিক্রম করে এই পথ গিয়ে পড়তো তাম্রলিপ্ততে ( এখনকার তমলুক)। তাম্রলিপ্ত থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে এই বাণিজ্য পারি দিত সুদূর শ্রী লঙ্কা, বালি, জাভা এবং অবশেষে ইউরোপে। এই ছিল প্রাচীন রেশম পথ। পূর্ব সিকিম ভ্রমণে রেশম পথ বলতে যা আমরা বুঝি, তা হলো আসলে এই প্রাচীন রেশম পথের প্রশাখা। তবে সে যাই হোক, ইতিহাস অনুসন্ধান করার থেকে শান্ত প্রকৃতির বুকে ঝাঁপ মেরে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার আনন্দ আমার কাছে অনেক বেশি। তাই এবারে মনস্থির করলাম মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের ৪ দিনের ছুটিটা সিল্ক রুটের তিনটি জায়গায় কাটিয়ে আসবো। সঙ্গী আমার অফিসের টিমের আরো চারজন – লীনা, বিদিশা, তথাগত এবং অর্চিতা। তথাগত এবং অর্চিতা নতুন এবং কনিষ্ঠতম সদস্য আমাদের ঘুরণচন্ডি দলের। নেট ঘেঁটে পেয়ে গেলাম লাকপা তামাং এর নম্বর। যোগাযোগ করে মোটামুটি একটা রুট প্ল্যানিং করে ২৮ মার্চ রাত্রের পদাতিক এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম আমি, লীনা আর বিদিশা। বাকি দুজন সেদিন বিকেল ৬টার রয়্যাল ক্রুজার ধরলো। ওদের শিলিগুড়ি ঢোকার কথা পরদিন সকাল ৬.৩০ তে আর আমাদের NJP ঢোকার কথা সকাল ৯ টায়।

২:

কিষানগঞ্জ যখন ছাড়লাম ফোনে তথাগতর সাথে কথা হয়ে আমরা হতবাক। ওরা তখনো ফারাক্কায় জ্যামে আটকে। পদাতিক আমাদের পৌঁছে দিলো NJP ১০ টায়। লাকপার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে SNT তে। হালকা জলখাবার খেয়ে আমরা গিয়ে মিলিত হলাম লাকপার সাথে শিলিগুড়িতে। পরিকল্পনা মাফিক আমাদের আজকের স্টে পদমচেনে, যা নাকি প্রায় ৫ ঘন্টার পথ। সমস্যাটা হলো রংলি থেকে রেশম পথের পারমিট করাতে হয় আর সেই অফিস বিকেল ৪টায় বন্ধ। এখন ঘড়িতে প্রায় ১২টা, খুব টেনে চালালে হয়তো ৪টার আগে রংলি ঢোকা যাবে কিন্তু কনিষ্ঠ দুই সদস্যকে আলাদা আসতে বলবো তাও মন চাইছে না। ওদের সাথে কথা বলে মনে হলো বেলা ২টোর আগে ওরা পৌঁছবে না। মনস্থির করা হলো যাই হোক, একসাথেই যাবো। গাড়িতে ব্যাগপত্র রেখে সময় কাটানোর জন্য চলে এলাম শালুগাড়া মনাস্টারিতে। শিলিগুড়ি শহরের ভেতরে এতো সুন্দর একটি মনাস্টারি আছে আগে সত্যি জানতাম না, লীনার ভ্রমণ সিধুজ্যাঠা মস্তিষ্কে ভাগ্যিস জায়গাটা লেখা ছিল। আমাদের দুজন বাস যাত্রী অবশেষে বিধস্ত হয়ে ঢুকলো ৩টের সময়ে। আমাদের সম্মিলিত দলকে হাতে পেয়ে লাকপা হাতে স্বর্গ পেয়ে ছুটিয়ে দিলো তার বোলেরো। প্রত্যেকবার মতো এবারেও শালুগাড়া ছাড়িয়ে মহানন্দা অভয়ারণ্যের পাশ দিয়ে যেতে যেতে টের পেলাম পাহাড়ী হাতছানি। তথাগতর এটি প্রথমবার। ওর বিস্ময় মাখানো “উরিববাস আমরা তো উঠছি”, “আরে ওই দেখো তিস্তা”, “আরও অনেকটা উঠবো”…ইত্যাদি শব্দগুলো বেশ লাগছিলো শুনতে। মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পুরোনো স্মৃতির ঢেউয়ের দোলায়।

৩:

রংপো যখন ঢুকলাম তখন সন্ধ্যা ৬.৩০। পদমচেন ঢুকতে গেলে পারমিটের প্রয়োজন অর্থাৎ আজ আর তা সম্ভব নয়। ঠিক করলাম রাতটা থাকবো লিংটাম এ। রংপোতে চটজলদি চা আর স্ন্যাকস খেয়ে রওনা দিলাম লিংটাম এর পথে। রংলি হয়ে লিংটাম পৌঁছতে লেগে গেলো আরও ১ ঘন্টা। লাকপা তার চেনা একটি হোম স্টে তে নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করে দিলো দুটি ঘরের, ৮০০ টাকা মাথা পিছু থাকা খাওয়া। লাকপার বাড়ি রোলেপে। রোলেপ রংলির যেহেতু খুব কাছেই, ঠিক হলো লাকপা আজ রাতে বাড়ি ফিরে যাবে এবং কাল সকালে রংলির পারমিট অফিস খুলতেই আমাদের পারমিট বের করে সোজা চলে আসবে লিংটাম। ৫০০০ ফুট উচ্চতার রাতের লিংটাম দুহাত ভরে আমাদের বিধ্বস্ত শরীরে মাখিয়ে দিলো ঠাণ্ডার এক পুরু প্রলেপ। পরদিন খুব সকালে ওঠার কোনো পরিকল্পনা নেই তাই একটু বেশি রাত অবধি জমিয়ে আড্ডা দিয়ে তবে শুতে গেলাম। পাহাড়ে এসে মনাস্টারি না দেখা অবধি লীনার নাকি ভাত হজম হয়না, তাই সকালে উঠে হোম স্টে থেকে একটু ওপরে পায়ে পায়ে চলে এলাম লিংটাম মনাস্টারি। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় মেঘলা আকাশ আর কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি দেখে মনে একটু সংশয় উকিঁ মারা শুরু করলো। তবে মনকে নিজেই আস্বস্ত করলাম এই ভেবে যে আরও ৪৫০০ ফুট ওপরে আকাশ কিরকম তা এখানে বৃষ্টি দেখে অনুমান করা অসম্ভব।

Lingtam village on silk route

Lingtam village

Lingtam monastery on silk route

Lingtam monastery

৪:

পারমিট বানিয়ে লিংটাম ঢুকতে বেশ কিছুক্ষন সময় লেগে গেলো লাকপার। অবশেষে প্রায় ১১টা নাগাদ সদলবলে আমরা যাত্রা শুরু করলাম জুলুকের পথে, অর্থাৎ রেশম পথে। হোম স্টে থেকে মিনিট ১৫ যেতেই এসে পড়লাম লিংটাম খোলা বা লিংটাম নদীর একেবারে বুকের মাঝখানে।

Lingtam river on silk route

Lingtam khola or Lingtam river

দুপাশের অজস্র বড় বড় পাথর আর সবুজে মোড়া পাহাড়ী ঢলের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এই নদী। কাঁচের মতো স্বচ্ছ টলটলে জল। রঙবেরঙের নুড়ি পাথর ঝকমক করছে জলের নিচে।

Lingtam river waters on silk route

Crystal clear waters of Lingtam river

Lingtam bridge on silk route

Lingtam hanging bridge

নদীর গভীরতা এখন স্বল্প তাই আমরা গাড়ি সমেত অনায়াসেই নদীর ওপারে চলে এলাম। পাশেই পায়ে হাঁটা একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। প্রকৃতির এই মোহময়ী রূপে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বেশ কিছু ছবি নিয়ে আবার আমরা রওনা দিলাম। আধ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম কুইখোলা ফলস।

Quikhola fall on silk route

Quikhola fall

Yellow orchids

Pink orchids on silk route near Quikhola

Pink orchids

পিচ রাস্তার একেবারে পাশেই এই ঝর্ণা। রাস্তার উল্টোদিকে অর্চিড দিয়ে সাজানো ছোটখাটো একটি খাবারের দোকান। এখানেই গরম মোমো আর ডিম সেদ্ধ খেয়ে প্রায় ১২.৩০ নাগাদ আমরা এগোলাম পদমচেনের দিকে। পাকদন্ডী রাস্তা বেয়ে যত উপরে উঠছি তাপমাত্রা ততটাই নিম্নমুখী হচ্ছে। শুরু হলো দুপাশে পাইনের জঙ্গল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া পাইনের সেই সবুজ ক্যানভাসে কে যেন কয়েকটা জায়গায় নকশা করে রেখেছে সাদা রডোডেনড্রন দিয়ে। মাঝে মধ্যেই গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার লোভটা সংবরণ করতে পারলাম না।

Padamchen on silk route

Padamchen

Mountain dog

Mountain dog

White flowers adoring the hill

White flowers adoring the hill

জুলুক যখন ঢুকলাম তখন ঘড়িতে প্রায় ২টো বাজে। লাকপা যে জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালো তার একপাশে দুই মানুষ উঁচু পাহাড়ী দেওয়াল আর অপর দিকে নিচে তাকালেই চোখে পরে অজস্র পাহাড় আর জুলুকের ছোট্ট গ্রাম এবং আর্মি বেস।

Zuluk on Silk Route

Reached Zuluk

Road through Zuluk hills

Road through Zuluk hills

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে সিকিমের এই প্রান্ত যেহেতু চীন সীমারেখার খুব কাছে তাই এখানকার বেশিরভাগ গ্রাম গুলোই আর্মি দ্বারা পরিচালিত। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি ৯৫০০ ফুট উচ্চতায়। ঝকঝকে রোদ থাকা সত্ত্বেও শীতল হাওয়ার ঝাপটা হাড়ে এসে বিঁধছে। পাইনের জঙ্গল বা অন্য বড় গাছের এখানে লেশমাত্র নেই। ছোট ছোট কিছু তৃণমূল আর সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া এখানকার পৃথিবী।

Villagers of Zuluk

Peace flags at Zuluk village

Peace flags

Beautiful sky over Zuluk

Beautiful sky over Zuluk

অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম…একটু আগেই লিংটাম থেকে যে পাহাড় গুলো মাথা উঁচু করে দেখতে হচ্ছিল, সেই পাহাড় গুলোই এখন এইখান থেকে ঝুকে মাথা নিচু করে দেখতে হচ্ছে। এ যেন ঠিক এক স্বর্গরাজ্য যেখান থেকে সমস্ত পৃথিবীটা আমাদের অনেকটা নিচে! উপরে তাকালে শুধুই ঘন নীল আকাশ আর সেই নীলের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে ঝকঝকে সাদা তুলোর মতো মেঘ।

৫:

পিচ রাস্তা ছেড়ে সরু একটি পাথুরে রাস্তা কিছুটা নিচে নেমে গিয়ে মিশেছে কয়েকটি কাঠের বাড়িতে। এর মধ্যে পাহাড়ের ঢালের একেবারে শেষ বাড়িটি হলো য়াংচেন হোমস্টে, আমাদের জুলুকের মাথা গোঁজার ঠাঁই। তিনটি বড় বড় ঘর, সামনে টানা বারান্দা স্লাইডিং কাঁচ দিয়ে ঢাকা। জানালা গুলো টেনে খুলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু একের পর এক পাহাড়ের সারী একটু একটু করে নেমে গেছে নিচে কোন অতল গভীরে।

View of Zuluk from homestay balcony

View of Zuluk from homestay balcony

ঠাণ্ডার দাপটে ততক্ষনে শরীরে উঠে এসেছে দুটি করে শীত বস্ত্র, মাথায় উলের টুপি এবং হাতে দস্তানা। বারান্দার নিচ থেকে ৪৫° এঙ্গেলে কিছুটা নিচ অবধি নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল। ক্যামেরা হাতে নেমে গেলাম সেই ঢালে আবার পরক্ষনেই উঠে এসে বারান্দার পাশের যে নীলচে কাঠের বাড়িটা, ক্যামেরা বন্দী করলাম সেটিকে।

Homestay at Zuluk on Silk route

Our homestay

Zuluk houses near our homestay

Houses near our homestay

এক কথায় বলতে গেলে….দু দিন উপসি থাকার পর আহারে পঞ্চ ব্যঞ্জন সমেত ধূমায়িত দেরাদুন চালের ভাত যদি কেউ এনে দেই, তাঁর যে অবস্থাটি হবে আমাদের এখন ভাবখানা অনেকটা তাই। প্রকৃতির পঞ্চ ব্যঞ্জনের মধ্যে কোনটা যে ছাড়ি আর কোনটা নি, তা ঠিক করাটাই দুস্কর। এই টানাপোড়েনের আপাত ইতি হলো, বাড়ির মালিকিনের ডাকে। আমাদের লাঞ্চ রেডি। গরম ভাত, আলুভাজা, ডাল, সবজি আর ডিমের ডালনা। মালকিনের রান্নার হাত যেমন অসামান্য, ঠিক তেমনই মুগ্ধ করে দেওয়া তাঁর অতিথিপড়ায়নতা।

৬:

বেলা যতো গড়াচ্ছে ঠান্ডা তীব্রতর হচ্ছে। সূর্যাস্ত আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যাবে। সূর্যাস্তের সময় ৫.৫০, অতএব হাতে এখনো বেশ কিছু সময় আছে। ৩ কিমি নিচে একটি শিব মন্দির আছে। লাকপার সাথে কথা বলে ঠিক হলো ও আমাদের গাড়িতে করে মন্দিরে নামিয়ে একটু দূরে যাবে ভলি বল খেলতে আর আমরা মন্দির দেখে জুলুকের গ্রামটা একটু উপভোগ করে হেঁটেই ওপরে উঠে আসবো শর্ট কাটে। বিপত্তি হলো খাওয়া দাওয়ার পরেই আমাদের কনিষ্ঠতম সদস্যা অর্চিতার শুরু হলো উচ্চতা জনিত স্বাসকষ্ঠের সমস্যা। তথাগতরও বুক ভারী লাগতে শুরু করলো। ভাগ্যিস নিচ থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে পপ কর্ন নিয়ে উঠেছিলাম। কিছুটা ধাতস্ত হলো দুজনেই পপ কর্ন খেয়ে। এখানে বলে রাখি যাঁদের উচ্চতা জনিত সমস্যা আছে তাদের অবশ্যই পপ কর্ন , কর্পূর এবং আদা রসুনের কোয়া সাথে রাখা দরকার। খুব উপকারী এই তিনটি জিনিস। যাইহোক, সুস্থ হয়ে উঠলেও অর্চিতা আর বেরোনোর সাহস পেলো না কারন হেঁটে উঠতে হবে অনেকটা। বাকি চারজন যাঁরা লাকপার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। মন্দিরের কাছে আমাদের ছেড়ে লাকপা বেরিয়ে গেলো। পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে যেন এখানে অপেক্ষা করে আছে কোনো এক নতুন দৃশ্য।

Zuluk village house

Bell at Shivalya temple

Child near the Shivalya temple

silk-route-tour-plan-shivalya-temple-top

Statue of Shiva on Shivalya Baba Mandir

Shivalya Baba Mandir at Zuluk

Shivalya Baba Mandir

মন্দির দর্শন সেরে আশপাশ টা একটু ঘুরে আমরা ফেরার পথে পা বাড়ালাম। পিচ রাস্তায় এসে দেখি একটি গাড়ি কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য আনলোডিং করছে। তাঁকে একবার অনুরোধ করতেই আমাদের গাড়িতে করে ওপরে পৌঁছে দিলেন। ভাড়া বাবত কিছু টাকা আমরা দিতে চাইলেও তিনি নিলেন না। ভৌগোলিক উচ্চতার সাথে সাথে মানুষের মনুষ্যত্বের উচ্চতাও বোধহয় বাড়ে !

Clouds over Zuluk

Floating clouds

 

Clouds over Zuluk

Clouds accumulating over the hills

 

৭:

৫টার মধ্যেই আমরা ফিরে এসেছি। ঠাণ্ডার প্রকোপ আরো বেড়েছে। ট্রাইপডে ক্যামেরা টা সেট করে রাখলাম বারান্দার স্লাইডিং গ্লাস সরিয়ে। শুরু হয়ে গেছে আকাশে রঙের খেলা। নিচের দিকে কিছুটা মেঘ এসে কখন দানা বেঁধেছে তা এতক্ষন টের পাইনি। সুদূর নীল পাহাড় গুলোর কোনটার পেছনে যে তিনি লুকিয়ে পড়লেন বুঝলাম না। বিদায়ের প্রমান হিসেবে শুধু ছড়িয়ে গেলেন এক মুঠো লালচে আবীর আকাশের কালচে বেগুনি ক্যানভাসে।

Sunset at Zuluk

Sunset behind the clouds at Zuluk

Blue hour

মেঘের আস্তরণ কাটিয়ে পূবের আকাশে জায়গা দখল করলো শ্বেত পাথরের থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই ৯৫০০ ফুট উচ্চতার শৈল নগরীকে জ্যোৎস্না স্নাত হতে দেখাকে ক্যামেরা বন্দী করার প্রলোভনে বাইরে চলে এলাম বটে তবে হিম শীতল হাওয়ার সপাটে কয়েকটা চড় খাওয়ার পর আর সেখানে বেশিক্ষন যুঝতে পারলাম না।

Night of Zuluk

Night of Zuluk

Zuluk at moonlight

Trying to get some slow shutter shots in the moonlight

লাকপাকে বলে রেখেছি আগামীকাল ভোর ৫ টায় বেরুবো লুংথাং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যোদয় দেখবার জন্য। অথচ মন চাইছে যেন আজকের রাতটা শেষ না হোক। একটু আগে লোডশেডিং হওয়াতে মালকিন পুত্র দুঘরে দুটো কাঁচের লম্প রেখে গেছে। বাইরের শনশনে হিমেল হাওয়া, হাড় মজ্জা কাঁপিয়ে দেওয়া ঠান্ডা, ওপরে কালো ক্যানভাসে রত্ন খচিত তারামণ্ডলী, উদার জ্যোৎস্নায় গা ভাসানো গিরীমালা এবং ঘরের ভেতর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা সভ্যতার আলো…সব মিলিয়ে এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ। যেখানে ভাবনা নেই, ইঁদুর দৌড় নেই, প্রযুক্তির চাকচিক্য নেই…আছে শুধু বাঁচার আনন্দের জন্য বেঁচে থাকা আর নিজেকে এই অনাবিল নিঃস্বার্থ প্রকৃতিরই এক অঙ্গ হিসেবে খুঁজে পাওয়া। এই নৈস্বরগিক রাত্রির শেষ বিন্দু অব্দি আমরা চেটেপুটে খেয়ে অবশেষে যখন অবসর নিলাম, রাত তখন প্রায় ২ টো।
৮:

১℃ তাপমাত্রায় ভোর ৪.৩০ টায় উঠে তৈরী হয়ে বেরোনো কষ্টকর তো বটেই তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখমণ্ডলে প্রথম আলোর স্পর্শ চাক্ষুস দেখার লোভ সব কষ্টই ম্লান করে দিলো। যথাসময় লাকপা আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। জুলুক থেকে লুংথাং ১৮ কিমি পথ। পাকদন্ডী বেয়ে যত উঠছি সবুজের অস্তিত্ব ততই কমছে, বদলে জায়গা নিচ্ছে ধূসর পাহাড়। ছোটবেলায় ১০ নম্বর তুলি জলরঙে ভিজিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ছিটালে যেমন স্প্রে পেইন্টিং হতো, পাহাড়ের আনাচে কানাচে সেরকমই মৃদু বরফের ছোঁয়া চারিদিকে।

Lungthung on silk route plan

View from Lungthung

“মোনাল, মোনাল..!” – শব্দগুলো প্রায় একইসাথে ঠিকরে বেরোলো লীনা, লাকপা আর আমার মুখ থেকে। গাড়ি থেকে ১০ ফুট দূরত্বে খাদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হিমালয়ান মোনাল। অবশ্য তাকে ক্যামেরা বন্দী করার সুযোগ আর সে দিলো না। ১১,২০০ ফুট ওপরে উঠে পৌঁছলাম থামবি ভিউ পয়েন্ট। জিগজাগ রোড ওপর থেকে দেখার জন্য এটি আদর্শ জায়গা। তবে সেটা ফেরার পথেও দেখা যাবে তাই না থেমে এগিয়ে চললাম। একটি হেয়ার পিন বাঁক ঘুরতেই বাঁ দিকে দেখা দিলো কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষীণ রেখা।

First glimpse of Kangchenjunga on silk route

First glimpse of Kangchenjunga

ডান দিকে ধূসর পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা বরফের নক্সা। ১১,৮০০ ফুট উচ্চতায় এসে অবশেষে আমরা থামলাম লুংথাং এ। ডান দিকে পূবের আকাশ আর বাঁ দিকে অনিরুদ্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘা তার আঁচল মেলে সূর্যের মুখোমুখি তাকিয়ে আহ্বান করছে তাঁর প্রথম আলোকের। আপাদমস্তক বরফে মোড়া শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন সত্যি কাঞ্চন বর্ণা। অবর্ণনীয় সেই রূপ।

Mt Kangchenjunga range on silk route

Mt Kangchenjunga range

Mt Kangchenjunga peak from silk route

Mt Kangchenjunga appearing from the clouds

Mt Kangchenjunga in golden hues of the morning

Mt Kangchenjunga in golden hues of the morning

দুই মহা শক্তির মাঝে কোনো এক বিচিত্র তরঙ্গে বাধা পড়লো আমার সারা শরীর ও মন। বাকিরা ঠাণ্ডার দাপটে গাড়ির ভেতরে। ওদের হাজার কাকুতি মিনুতিতেও ফিরে যেতে পারছিনা গাড়িতে। শুধু একের পর মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করে চলেছি। জীবনে এই প্রথম অনুভব করলাম প্রকৃতিরও কি অসীম সম্মোহনী ক্ষমতা! রঙের এই খেলা যখন শেষের দিকে তখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। গাড়িতে গিয়ে বসায় আস্বস্ত হলো সাথীরা। ফেরার পথে থামবি ভিউ পয়েন্টে নেমে চাক্ষুস করলাম সেই অতি পরিচিত জিগজাগ ভিউ। জুলুকের রাস্তার সেই স্বরপিল বাঁক গুলো সত্যি দৃষ্টি নন্দন।

Silk route-tour-plan-zuluk-zigzag-roads

Zuluk zigzag roads

৯:

হোম স্টে তে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নাথাং এর উদ্দেশ্যে। একটু আগে যে পথে লুংথুং গেলাম সেই একই পথে আবার ওঠা। ঝকঝকে রৌদ্রে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট থেকে জুলুকের জিগজাগ পথ টা এখন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে দূর মেঘ জমে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে রেখেছে। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস ভোরবেলা বেরিয়েছিলাম। লুংথুং ছাড়িয়ে গাড়ি উঠতে থাকলো আরো আরো ওপরে। ঠান্ডা বাড়ছে হুহু করে। ধূসর পাহাড়ের গায়ে শুকনো ঝোপ ঝাড়ের ফাঁকে আটকে আছে থোকা থোকা বরফ। নাথাং ঢোকার আগে আছে একটি ক্যাফেটেরিয়া। সেখানে নেমে আমরা ভাড়া নিলাম স্নো বুটস, প্রতি জোড়া ১০০ টাকা।

On way to Gnathang

Drizzling snowfall at the cafe

ক্যাফেটেরিয়ার সামনের সিঁড়ির পাশে স্তূপীকৃত হয়ে আছে অল্পকিছু জমে থাকা বরফ। তবে এ ছাড়া আর কোথাও বরফ চোখে পড়লো না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে তাই সূর্যের কোনো দেখা নেই। সেই সুযোগে ঠান্ডা তার কামড় আরও শক্ত করেই চলেছে। মোটা উলি কর্ড ওপর জ্যাকেট, মাথায় উলের টুপি, হাতে গ্লাভস…সব চাপিয়েও যেন মনে হচ্ছে আরও কিছু হলে ভালো হতো। কফি খেয়ে বাইরে এসে দেখি ফোটা ফোটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার কালো জ্যাকেটের হাতায় চোখ পড়তে বুঝলাম বৃষ্টি নয়, এতো তুষারপাত! তবে বরফ কণা গুলো এতই ক্ষুদ্র যে ভালোভাবে না দেখলে বোঝা মুস্কিল এ তুষারপাত না বৃষ্টি।

Snowfall started at Gnathang valley on silk route tour

Snowfall started at Gnathang valley

১০:

গাড়ি নিয়ে মিনিট সাতেক আরো এগোতেই আমরা পৌঁছে গেলাম নাথাং ভ্যালি। রাস্তার বাঁ পাশে খাদের লাগোয়া একটি ছোট্ট দোকান। খাদের দিকে একটু নিচে তাকালেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি গ্রাম।

Gnathang village from top on silk route tour

Gnathang village from top

চারদিকে স্বল্প উচ্চ পাহাড় ঘেরা সমতলটা দেখে মনে হলো ঠিক যেন ছোট্ট একটি ঝুড়িতে সাজানো কয়েকটা রঙবেরঙের খেলনা বাড়ি।  ডান দিকে পাহাড়ের দেওয়াল ঢেকে আছে বরফে। পাহাড় এখানে খাড়াই নয়। এ এক স্বর্গীয় উপত্যকা যাকে ছোঁয়া যায়, যাকে অনুভব করা যায় একেবারে কাছ থেকে। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হলো তুষারপাত।

Snowfall on Gnathang road to silk route

Snowfall on Gnathang road

Deep snowfall at Gnathang on silk route tour

Our group with Lakpa

ক্যাফেটেরিয়ার মতো আর সে ক্ষুদ্র কণা নয়। ১৩,৫০০ ফুট উচ্চতায় এক বরফের দেশে পৌঁছে গেছি আমরা। দূরের পাহাড় গুলো সাদা হয়ে আছে বরফের পুরু আস্তরণে। “আপ লোগ লাকি হো।” – লাকপার এই মন্তব্যের অর্থ হলো বরফ অনেকেই পায় এই জায়গায় কিন্তু তুষারপাতে মধ্যে দাঁড়িয়ে বরফকে অনুভব করার সে এক অন্য মাত্রা। আমার জীবনে এমন বরফের দেশে আসা এবং তার সাথে তুষারপাত এই প্রথম। শব্দকোষ হাতরে শুধু এই কয়েকটি শব্দই খুঁজে পেলাম – ” যাহা দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও তাহা ভুলিব না।” রাস্তার দুপাশে জমতে শুরু করেছে বরফ। বাড়তে শুরু করেছে তুষারপাত আর তারসাথে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। লাকপার তাগাদায় এগিয়ে চললাম গাড়ি নিয়ে পুরোনো বাবা মন্দিরের পথে। যত এগোচ্ছি ততই চারিদিক শুভ্র থেকে শুভ্রতর হচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে দেখি এক জায়গায় দুটো গাড়ি সাইড করে দাঁড়িয়ে টুরিস্ট নিয়ে। লাকপা ড্রাইভার দুজনের সাথে কথা বলে আমাদের যা বললো তার সারমর্ম হলো এই যে…রাস্তা যেকোনো সময় বিপদ সংকুল হয়ে যেতে পারে কারণ তুষারপাত আরো বাড়ছে আর তাই ওই দুটো গাড়ি এইখান থেকেই ব্যাক করছে। বাবা মন্দির এইখান থেকে খুবই কাছে তাই সাহস নিয়ে এগোলাম। ইতিমধ্যে রাস্তার পিচের ওপর পড়তে শুরু করেছে বরফের মিহি একটা কোটিং। সেনাবাহিনীর জয়ান বাবা হরভজন সিং এর বাংকারটিকেই তাঁর মন্দিরের রূপ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যবহৃত কিছু সরঞ্জাম আজও অক্ষত আছে এই বাংকারে।

Old baba mandir on silk route

Old baba mandir

silk-route-tour-plan-old-baba-mandir-bunker

Bunker of Baba Harbhajan Singh

Baba Harbhajan Singh on silk route tour

Baba Harbhajan Singh

১৪,০০০ ফুট ওপরে সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে যেসব জওয়ানেরা পাহারা দেন দেশের সীমাকে তাঁরা আজও বিশ্বাস করেন বাবা হরভজন সিং আজও আসেন তাঁদের পাশে…তাঁদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আজও এবং অনন্তকাল ধরে তিনি রক্ষা করে চলেছেন দেশকে।

১১:

মন্দির দর্শন করে বাইরে এসে দেখি রাস্তা পুরোটাই বরফে ঢাকা এবং লাকপার কিঞ্চিৎ চিন্তিত মুখ। আর কিছুটা এগোলেই পেয়ে যাবো কুপুপ লেক, টুকলা ভ্যালি, জেলেপ লা পাস এবং ফোর লেক পয়েন্ট। লাকপার গভীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের উৎসাহ দেখে এগোতে থাকলো খুব ধীরেসুস্থে।

Old baba mandir on silk route

Snow covered roads in front of old baba mandir

রাস্তাটিও এখানে সরু হয়ে এসেছে। ৩০০ মিটার মতো গিয়ে একটা বাঁকে পরিষ্কার বুঝলাম সামনের বাঁ দিকের চাকাটা অল্প কিছুটা স্কিড করলো। আমি সামনে বসে। লাকপা গাড়ি থামিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো আমার সাথে। থমথমে আর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বেচারার মুখ। “No more. Let’s get back” – শব্দগুলো আমার অজান্তেই বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। রাস্তা এত সরু আর পিচ্ছিল যে U টার্ন নেওয়া সম্ভব হলো না। ওই ৩০০ মিটার ব্যাক গিয়ার্ এই পিছিয়ে বাবা মন্দির অবধি এসে তবে গাড়ি ঘোরানো গেলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন সকলে। ফিরতি পথে কিছুটা এগিয়ে দেখি একজায়গায় লাইন দিয়ে ৭-৮ টা ট্যুরিস্ট গাড়ি দাঁড়িয়ে।

silk-route-tour-plan-stranded-on-snow

Cars stranded on deep layers of snow

লাকপা খোঁজ নিয়ে এসে বললো আর এগোনো সম্ভব নয় কারণ রাস্তা ততক্ষনে পুরু বরফের আস্তরণে ঢেকে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখি জ্যাকেটের ওপর ভাগটা শেভিং ফোম দিয়ে ঢেকে দিয়েছে কে একটা। তুষারপাত এতটাই প্রবল যা পাচ্ছে সামনে পুরু বরফের আস্তরণে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলছে তাকে মুহূর্তের মধ্যে। দাঁড়িয়ে থাকলে স্নো বুটের সামনের ভাগটা ঢাকা পরে যাচ্ছে বরফের নিচে। এ যেন এক বরফের মরুভূমিতে পৌঁছে গেছি।

Ice all over on silk route near Gnathang

Ice all over

Heavy snowfall on silk route tour

Heavy snowfall has statrted

Car in snow on silk route

Car in snow on silk route

যতদূর যেদিকেই চোখ যাচ্ছে শুধু সাদা আর সাদা। যে গাড়িগুলোর একটিু আগেও রং বোঝা যাচ্ছিল সেগুলো এখন শুধুই সাদা। বনেটের ওপর স্তূপীকৃত হয়ে আছে সদ্য ঝরা হালকা শোলার মতো বরফ। এত প্রতিকূলতা অথচ তার মধ্যেও কি অকল্পনীয় সুন্দর চারিদিক।

১২:

“আপ লোগ মেরে খেয়াল সে তিন কিমি পেয়দাল চলে যাও ক্যাফেটেরিয়া তক। কিউকি হো সকতা হেই গাড়ি রাত ভর য়েহী রাখনা পারেগা।” – লাকপার এই কথায় এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর দেশ থেকে এক ধাক্কায় বেরিয়ে কঠোর বাস্তবে এসে পড়লাম। আমরা আটকে গেছি এই বরফের মরুভূমিতে। অর্চিতার এদিকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে বরফে এতটা রাস্তা হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। সিদ্ধান্ত নিলাম যাই হোক না কেন একসাথেই করবো যাই করি। ঘড়িতে তখন প্রায় ২টো বাজে। লাকপার তৎপরতা ও উপস্থিত বুদ্ধিতে অবশেষে একটি ব্যবস্থা হলো। নাথাং ভ্যালির এক হোম স্টের নিজস্ব গাড়িতে চেন লাগানো আছে পেছনের দুটি চাকায়। সেই গাড়ি কিছুক্ষনের মধ্যে এসে হোম স্টে অবধি নিয়ে যাবে। শরীর ও মনে বল পেলাম। এখানে বলে রাখি, চেন ছাড়া এহেন বরফের রাস্তায় কোনো গাড়ি যেতে পারে না। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়িটি এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে গেলো হোম স্টের রাস্তায়। অবশ্য কোনটা যে রাস্তা আর কোনটা মাঠ তা বোঝা মুস্কিল কারণ সবই পুরু বরফে ঢাকা পরে গেছে।

silk-route-tour-plan-gnathang-valley

Gnathang valley, a small village on the top of the world

Houses deep in ice at Gnathang

Houses deep in ice

এক দুটি জায়গায় তো হোম স্টের গাড়িও দেখলাম আন্দাজের ভিত্তিতে চালালো। হোম স্টের সামনেই একটা বেশ বড় ফুটবল খেলার মাঠ আছে। গোলপোস্ট দুটি শুধু বরফের চাদর থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাছাড়া সেটা যে মাঠ টাআর কোনো চিহ্নই নেই। হোম স্টে তে পৌঁছে মানসিক ভাবে অনেকতা স্বস্তি পেলাম।

১৩:

ঘর দুটি একটু স্যাঁতস্যাঁতে হলেও জানালার বাইরের দৃশ্যাবলী তার পরিপূরক। ঘরে ঢুকে জানালা গুলো খুলতেই দমকা হওয়ার মতো একরাশ ভালোলাগা চোখে মুখে এসে লাগলো। সমস্ত বাড়ির চালগুলো বরফে মোড়া। কোথাও একটুকরো মাটি উকিঁ দিচ্ছে না তা সে সামনের মাঠ হোক, রাস্তা হোক, বাড়ির উঠোন হোক কিংবা সামনের বা দূরের পাহাড় হোক। সামনের ঐযে পাতা ঝরা শুকনো বেঁটে গাছ গুলো, সেগুলোর ডালে ডালে শাখা প্রশাখাতেও জড়িয়ে আছে বরফের প্রলেপ।

Dog just outside our homestay window

Dog just outside our homestay windowএ কোথায় এসে পড়েছি আমরা? এমনটাও কি সত্যি হয়? স্বর্গের রূপ কি এমনই হয়? এই গ্রামে মানুষ দিনের পর দিন থাকে কি করে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ডাক পড়লো লাঞ্চ এর। লাঞ্চ সেরে খেয়াল করলাম কেউই আমরা স্নো বুটস গুলো খুলিনি পায়ের থেকে। আসলে সকলেরই মনে একই ইচ্ছে – দিনের শেষ আলোটা থাকা অবধি এই বরফের দেশটাকে যতটা সম্ভব রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাছ থেকে অনুভব করা। বেলা গড়িয়ে এখন বিকেল। বেরিয়ে বাঁ দিকে কয়েক পা হাঁটতেই দেখি সামনের পাহাড়টা থেকে নেমে আসছে ইয়াকের দল।

 

 

 

Yak at Gnathang valley on silk route tour

Yak at Gnathang valley

Sunset over Gnathang valley on silk route tour

Sunset over Gnathang valley

সুবিশাল যে মাঠটি এখন সম্পূর্ণ বরফের চাদরে ঢাকা, সেখানেই এসে জড় হলো ইয়াকের দল। হয়তো ঘাসের খোঁজে এটাই তাদের বিকেলের আস্তানা। রোজকার মতো অভ্যাসবশত আজও তাই চলে এসেছে তারা। সূর্য দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে সামনের ওই যে দুটি পাহাড়ের মাজখানে যে ঢালটা, ওখানেই একটু একটু করে ডুবে যাবেন তিনি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই। যাবার আগে বেগুনি রঙের এক আলোকমালা ছড়িয়ে দিয়েছে সে আকাশের বুকে যার প্রতিফলন বরফের গায়ে গায়ে।

Strolling on Gnathang valley

Strolling on the ice at Gnathang valley after lunch

Gnathang valley in afternoon on silk route tour

Gnathang valley village dipped in snow

Truck stuck in snow at Gnathang on silk route tour

A truck stranded in ice

Temple at Gnathang on silk route

Temple at Gnathang

একটু এগোতেই চোখে পড়লো কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরানো একটি শ্রী কৃষ্ণ মন্দির গ্রামের একেবারে অন্তিম প্রান্তে। মন্দিরটির পেছনদিক থেকেই উঠে গেছে একটি পাহাড়। গোধূলির শেষ আলোতে সত্যি মায়াবী চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই বরফের দেশ।

Beautiful Gnathang valley after sunset

এমন সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করার ধৃষ্টতা বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। শুধু বুকের গভীরে অনুভব করলাম কে যেন অনবরত বলে চলেছে –

“স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, স্বার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে।”

দিনের শেষ আলোর রেখাটি মিলিয়ে যেতেই শীতের কামড় দাঁত বসলো ভয়ঙ্কর ভাবে। ঘরের ভেতর ঢুকে শুধু জুতোটা ছাড়ার সাহস পেলাম। দস্তানা, টুপি সমেত শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক পরিবেষ্টিত হয়ে একাধারে লেপ ও কম্বলের নিচে ঢুকেও যেন রক্ষা নেই। জানি গতকাল পূর্ণিমা গেছে, এই মুহূর্তে যদি বাইরে যাওয়া যায় ক্যামেরা নিয়ে আর যদি মেঘ বিহীন আকাশ পাই তাহলে পেলেও পেতে পারি জ্যোৎস্না স্নাত বরফের দেশের অমূল্য কিছু ছবি। জানালার বাইরে মুখ বার করে অবশ্য খুঁজে পেলাম না চাঁদ, হয়তো কোনো মেঘের আড়ালে তিনি মুখ ঢেকেছেন। তবে এই সাব জিরো তাপমাত্রায় আর বাইরে গিয়ে তাঁর অপেক্ষায় করার সাহস আর শক্তি কোনোটাই পেলাম না।

১৪:

সকালে ঘুম ভাঙ্গতে প্রায় ৭টা বাজলো। কাল বিকেলে যেদিকটায় গেছিলাম আজ তার উল্টোদিকে হাঁটা লাগালাম। ঝকঝকে সুন্দর রোদ তবে বরফ এক কণাও গলেনি। শুধু ঘরের ছেলে যে পুরু বরফের চাঁই জমে ছিল রৌদ্রের তাপ পেয়ে সেগুলো একটু আলগা হয়ে পিছলে পিছলে পড়তে শুরু করেছে।

Gnathang on morning sun at silk route tour

Morning sun melting the ice from roof

আমাদের হোম স্টেটি একেবারে শেষ প্রান্তে হওয়াতে কাল গ্রামটির স্বাদ সেরকম পাইনি। আজ সকালে এদিকটায় হাঁটতে বেশ লাগছে। কাঠের বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে উঁচু নিচু রাস্তা। কোথাও বা কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সবই অবশ্য পুরু বরফে ঢাকা তাই সাবধানে বুঝে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে। রৌদ্রের দেখা পেয়ে গ্রামবাসীদের চোখে মুখে একটা উজ্জ্বল ভাব। বেশিরভাগ বাসিন্দারাই এখানে তিব্বতী। কোথাও বা বাড়ির পুরুষ সদস্যরা বেলচা নিয়ে বরফ সরানোর কাজে লেগে গেছে, কোথাও বা এক প্রৌঢ়া তাঁর আদরের নাতনিকে নিয়ে কাঠের ঘেরানো দোলনায় রোদ পোহাচ্ছেন।

Owner clearing ice from homestay entrance at Gnathang on silk route tour

Our homestay owner clearing the ice from the entrance door

Grandma bathing in the morning sun at Gnathang on silk route tour

Grandma bathing in the morning sun

 

একটা জায়গায় এসে দেখি ছোট্ট একটা লোহার পুল। নিচে জমে সরু জলের ধারা, যেন চলমান জলধারাটিকে কোনো এক পরী তার জাদু দণ্ডের বলে থামিয়ে রেখেছে। পুল পেরোতেই এদিকের শেষ প্রান্তে যে মনাস্টারিটি আছে চলে এলাম সেটার সামনে। মনাস্টারির প্রবেশ দ্বারটি বানানো বেশ সুন্দর লাল আর হলুদ থামের ওপর। তাতে ইংরেজি তে লেখা Welcome To Gnathang.

Gnathang monastery pillars

Gnathang monastery pillars

Gate to Gnathang valley monastery

Gate to Gnathang valley monastery

Gnathang monastery on silk route tour

Gnathang monastery

১৫:

হোম স্টেতে ফিরে এসে জলখাবার সারলাম এক বাটি গরম ম্যাগি দিয়ে। আজ ১লা এপ্রিল। ফেরার ট্রেন NJP থেকে রাত ৯.১৫য়। গতকাল লাকপার থেকে বিদায় নেওয়ার পর তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। হোম স্টের মালিকের ছেলে নিজেই গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিল এখানে। তাঁর থেকে শুধু এটুকুনি জানলাম যে লাকপার সাথে আমরা মিলিত হবো জুলুকের পথে কোথাও একটা। গাড়ির নম্বর খেয়াল রেখে এগিয়ে যেতে হবে। জুলুক অবধি উনি আমাদের নামিয়ে দেবেন। রোদ থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়াই শ্রেয়। তাই এই স্বপ্নদেশের মায়া কাটিয়ে বেরোতেই হলো। পেছনে ফেলাম শুধু একটি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি – “আবার আসিব ফিরে।” হ্যাঁ, সত্যিই তাই। এ স্বপ্নলোক ভুলবার নয়। অমোঘ তার আকর্ষণ…তার সম্মোহনী ক্ষমতা, ফিরে যে আসতেই হবে তার কোলে আবার এ জীবৎকালে। ক্যাফেটেরিয়া অবধি রাস্তায় এখনো পুরু বরফ। হোম স্টের গাড়ির চাকায় চেন লাগানো না থাকলে এটুকুনিও আসা সম্ভব হতো না।

Melting snow in daylight at Gnathang

Melting snow in daylight

Cafe at Gnathang at the time of returning

স্নো বুট গুলো জমা দিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। মিনিট পাঁচেক চলার পর উল্টোদিক থেকে আসা একটি ট্যুরিষ্ট গাড়িকে দাঁড় করানো হলো। ওনারা যাচ্ছেন নাথাং। তবে চাকায় চেন নেই তাই আর এগোতে পারবেন না কারণ এরপরের রাস্তাতো বরফে ঢাকা। সমস্যার সমাধান করলো হোম স্টের মালিক পুত্র। তিনি চেন ওয়ালা গাড়িতে ওই ট্যুরিষ্টদের তুলে নিয়ে ফেরত চললেন নাথাং আর আমাদের বসিয়ে দিলেন চেন বিহীন টুরিস্ট গাড়িটিতে জুলুকের পথে যেহেতু ওদিকে আর বরফ নেই। জুলুক ঢোকার একটু আগেই লাকপার দেখা পেলাম আমাদের গাড়ি সমেত। উঠে পড়লাম নিজেদের বাহন টিতে। একটু একটু করে নামতে থাকলাম জুলুক, পদমচেন, লিংটাম, রংলি, রংপো পার হয়ে। মেল্লী পৌঁছে দেখি তিস্তার ওপর রিভার রেফটিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। শর্টটি ৩০ মিনিটের, ভাড়া ৪০০০/- এবং লং ৫০ মিনিটের,ভাড়া ৫০০০/-। একটি রাফটে ৬ জনকে অনুমতি দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে গাইড এবং তার সহকারী। আমরা ছিলাম ৫ জন তাই লাকপাকেও টেনে নিলাম দলে লং ট্রিপটির জন্য। ইনফ্লাটেবল বোটটি ওদের নিজস্ব গাড়িতে বেঁধে নিয়ে চলে এলাম রাফটিং পয়েন্টে। পরনে সকলের লাইফ জ্যাকেট এবং হাতে রোয়িং প্যাডেল। ফরওয়ার্ড, ব্যাকওয়ার্ড এবং নিল ডাউন ভালো করে বুঝিয়ে আমাদের রাফটে তুললেন গাইড। তিস্তার জল এখানে নীলচে সবুজ এবং বেশ ঠান্ডা। শুরু হলো তিস্তা অভিযান। একেকটি ঢেউ যখন আছড়ে পড়ছে রাফটে  আমাদের আপাদমস্তক চুপচুপে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

silk-route-tour-plan-teesta-river-rafting

River rafting on Teesta

এই ঢেউ গুলো ওনাদের ভাষায় “লেহের”। এই লেহেরেই রাফটিং এর আসল মজা। একেকটা লেহের রাফটিং বোট টিকে শূন্যে তুলে দিচ্ছে অনেকখানি। পরমুহূর্তেই আছড়ে পড়ছি তিস্তার বুকে। এডভেঞ্চার এর স্বাদ পুরোদস্তুর উপভোগ করলাম ৫০ মিনিট। নেমে ওদেরই চেঞ্জ রুমে পোশাক বদল করে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির পথে। সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ শিলিগুড়ি ঢুকে বিদায় নিলাম লাকপার থেকে। খারাপ লাগলো ওকে বিদায় জানাতে।

Lakpa

এই তিনটি দিনে ছেলেটি যেন ঠিক আমাদেরই পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। বিদায় পূর্বে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর হালকা হাসিমুখের -“ফির আইয়েগা দাদা” বোধহয় চোখ টা ছলছল করিয়ে দিলো। আমারও আর ওরও হয়তো। ওর পিঠে হাত রেখে শুধুই একটি কথা বকতে পারলাম  – “Lakpa, we shall meet again.”

© Arijit Kar

0 0 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: