Skip to content
Home » বর্ষাবিহারে বিহারিনাথ

বর্ষাবিহারে বিহারিনাথ

Share this in your social media

Biharinath Hill

বর্ষাবিহারে বিহারিনাথ

১:

বেলা তখন প্রায় ১২ টা। ড্রাইভারের কাঁধ বরাবর wind screen ভেদ করে সামনের যে দৃশ্য টা একটু একটু করে আমার সামনে উঠে আসলো, তা দেখে গত ৪.৩০ ঘন্টার ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে গেল আমার। ঠিক আমার সামনেই এক পৃথিবী সবুজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিহারিনাথ পাহাড় or Biharinath Hill। আর তার backdrop এ ঘন কালো মেঘের চাদর। বর্ষা ভেজা সবুজ…. মন টাকে যে কোন অজানা ভালোবাসার দেশে হাত ধরে নিয়ে চলে যায়, তা নিজেও টের পাইনা। সম্বিৎ ফিরে পেতে মন টা একটু খারাপ হলো বৃষ্টি দেখে। কি করবো? ক্যামেরা টাকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কোনো সরঞ্জাম তো আনিনি।

২:

বিহারিনাথ অতিথিনিবাস খুঁজে পেতে একটুও বেগ পেতে হলো না। ওখানকার ম্যানেজার শিন্টু চক্রবর্তীর ( 9732274266) সাথে আগেই কথা বলে বুকিং করে নিয়েছিলাম একদিনের। ঘরের বারান্দায় গিয়ে মন তা ভরে গেল। সামনে বিহারিনাথ পাহাড় পুরোপুরি দৃশ্যমান। সকাল ৬.১৫ র ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে রানীগঞ্জ। সেখান থেকে বাস এ শালতোরা প্রায় ১.২০ ঘন্টার রাস্তা। শালতোরা থেকে  অটোতে বিহারিনাথ আধ ঘন্টার রাস্তা। এই রাস্তাটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে..যেন বিহারিনাথের একটি ট্রেইলার এই রাস্তাটি। ঠিক করলাম লাঞ্চের পর অল্প বিশ্রাম করেই বেরিয়ে পড়বো বিহারিনাথের সাথে গোধূলির প্রেমে আবদ্ধ হতে।

৩:

হোটেলে ঢোকার আগেই খেয়াল করেছিলাম হোটেলের পেছনের রাস্তা টা বেশ সুন্দর। দেখলেই হাঁটতে ইচ্ছে করে এই সরু ৮ ফুটের রাস্তা দিয়ে। বিকেল ৪ টা নাগাদ দেখলাম বৃষ্টি থেমে উঁকি দিয়েছে রোদ পড়ন্ত বেলায়। বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম বিহারিনাথ মন্দির। প্রচলিত আছে খুব জাগ্রত এই মন্দির। শ্রাবন মাসে শিবের মাথায় জল দেবার জন্য এতটাই ভিড় হয়ে যে তিল ধরণের জায়গা হয়না। সর্ব সাকুল্যে তিনটি থাকার জায়গা। অতিথিনিবাস (যেখানে আমি আছি), টুরিস্ট পয়েন্ট এবং WBSFDA এর eco tourism cottages। আমার ভাগ্য ভালো যে শ্রাবন মাস পড়তে তখনও ৪ দিন বাকি…আমি একটু  নিরিবিলি পছন্দ করি। যাইহোক, মন্দিরটি তে ঢুকে মনে হলো এখানেও আরাম করে ৩-৪ ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। বাংলার অন্যান্য মন্দিরের থেকে বেশ আলাদা। আমি ছাড়া তখন আর ১-২ জন টুরিস্ট। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে দেন হাতে মূল মন্দির। সামনে অনাবৃত বিহারিনাথ আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। প্রবেশদ্বারের উল্টো দিকেই একটি দীঘি। সেখানে দেখলাম ছিপ ফেলে কয়েকজন মাছ ধরছে। অদ্ভুত এক শান্ত পরিবেশ চারিদিকে। মন্দিরের প্রতিটি ফলকে যেন শান্তি বিরাজমান। বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে হাঁটা লাগালাম অতিথিনিবাসের পেছনদিকের রাস্তায়। একটু এগোতেই বাঁ দিকে তাকাতেই দেখলাম ধূধূ মাঠ। আর তারপরেই বিহারিনাথ পাহাড় তার শ্যামল মমতার আঁচল মেলে আমায় আহ্বান করছে। ডান দিকে যতদূর চোখ যাবে, খালি জমি। কোত্থাও কিছু নেই। সুদূরে শুধু কিছু উচু টাওয়ার থেকে অবিরাম আগুনের লেলিহান শিখা। ওগুলো burnpur এর সিমেন্ট কারখানা পরে জেনেছিলাম। সূর্য তখন ডুবুডুবু। আকাশে মেঘের ঘনঘটা তখনও থাকাতে এক নৈস্বরগিক রূপ নিয়েছে চারিদিক। কালো মেঘের চাদর সরিয়ে উকিঁ মারছে অস্তায়মান সূর্য। মেঘের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে এক স্বর্গীয় রশ্মি যা আমাকে সম্মোহিত করলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি হেঁটে চলেছি…দূরে…আরো দূরে। আমার নিজের সত্তা যেন বিলীন হয়ে গেছে গোধূলির এই রূপের ছটায়। ” বাবু, এদিকে কোথায় যাবেন? ” শুনে একটু চমকে গেলাম। নিজের হারানো সত্তা খুঁজে পেলাম। বললাম..এই একটু হাঁটছি। লোকটির height ৫’৩’ এর বেশি মনে হয়না হবে। মুখের সাদা দাড়ি না থাকলে বোঝার কোনো উপায় নেই বয়স হয়েছে। পরনে সাদা ধুতি হাঁটু অব্দি বেশ ফিটফাট করে বাঁধা। বললেন ” সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এদিকটায় আর বেশি দূর যাবে না । শিয়াল, হায়না মাঝে মাঝেই বেরোয়”। জন্তু জানোয়ারের কথা অতটা বিশ্বাস না হলেও, লোকটাকে আমার বেশ লাগলো। ওনাকে একটু culture করার উদ্দেশ্যে  গল্প জুড়ে দিলাম ওনার সাথে। নাম ওনার অজিত বাউরি। জানলাম উনি WBSFDA এর কেয়ারটেকার। তবে permanent নন। ওনাকে রিকোয়েস্ট করাতে আমাকে নিয়ে এলেন ফরেস্ট এর কটেজ গুলোয়, দেখাবার জন্য। দেখলাম কটেজ গুলো থেকে পাহাড় দৃশ্যমান নয় ঠিকই, তবে বেশ একটা গা ছমছমে ভাব আছে সন্ধ্যের দিকে কটেজ গুলোয়। শেষ কটেজ টা থেকে ১০ হাত এগোলেই জঙ্গল শুরু। এই জঙ্গল সমতল অব্দি কিছুটা গিয়ে সোজা বিহারিনাথ পাহাড়ে উঠে গেছে। ওদের কম্পউন্ডের এদিকটা পেছনের দিক। একটা ভাঙাচোরা গেট আছে…সেখান থেকেই জঙ্গল শুরু। সামনের entry gate টা অবশ্য যথেষ্ট secured। জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেলাম। এমনিতে online ছাড়া booking হয় না। তবে তখন রুম গুলো খালি। ওখানেই ঠিক করে নিলাম, একরাত্রি থেকে আমার বিহারিনাথের আশ মিটবে না। অজিত কাকা কে বললাম দ্বিতীয় রাত টা ওনাদের কটেজ এ থাকতে চাই। উনি বললেন অনলাইন বুকিং ছাড়া তো হবে না। JIO র ডাটা নেটওয়ার্ক এখানে গণ গণ করে চলছে, তাই কাকা কে বললাম অনলাইনের  ব্যাপারটা আমি করে নেব, ও আপনাকে ভাবতে হবে না…কালকে আমি আপনার সাথেই থাকবো এখানে। শুনে কাকার একগাল হাসি। আসলে কথা বলার লোক পান না তো উনি। বললাম কাল কিন্তু আমি জায়গা টা বেশ ভালো করে ঘুরে দেখতে চাই, আপনি আমাকে ডিটেলস এ বলে দেবেন কোথায় কোথায় যাবো। এর উত্তরে কাকা যা অফার দিলো আমাকে…শুনে মনে হলো, কাল সত্যি আমার আসা টা সার্থক হতে চলেছে। ঠিক হলো পরের দিন সকাল ৮টা নাগাদ আমি মালপত্র নিয়ে এখানে চলে আসবো। তারপর  দুজনে মিলে trekking এ যাবো। ৪.৫ কিমি যাওয়া এবং ৪.৫ কিমি ফিরে আসা। ৯ কিমি টোটাল হাঁটা। তবে এর মধ্যে ৯০% টাই gradual trekking । পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই পথ, মাঝে পড়বে আদিবাসী গ্রাম, উরেস্বরী মন্দির, পাহাড়ী ঝর্ণা, এক মুনির আশ্রম পাহাড়ের ওপর আর পাহাড়ি অরণ্যের স্বাদ। শুনে যেন আমার আর তরশ হয় না। অধীর আগ্রহে সকালের অপেক্ষা নিয়ে, ওনাকে বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরলাম।

৪:

রাত্রে খাওয়া দাওয়ার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। অন্ধকারে আবছা বিহারিনাথ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলাম কাল যেন পরিষ্কার আকাশ পাই। ইচ্ছা শক্তি বলে একটা জিনিস আছে, তা সকালে উঠেই প্রমাণিত হয়ে গেল। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ আর রোদ চারিদিকে। আর দেরি না করে সোজা চলে গেলাম কটেজ এ। গেট খুলে ঢুকতেই দেখি অজিত কাকা আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। বুঝলাম আমার মত ভবঘুরে পেয়ে উনিও বেশ উৎসাহিত। একটু ফ্রেশ হয়েই ওনার সাথে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। আজ অজিত কাকা বেশ সাজুগুজু করে এসেছেন। সাদা শার্ট, খয়েরি প্যান্ট। হাতে একটা মোটা ডাল কোনো এক গাছের। আর একটি ডাল আমার জন্য। বললেন ইটা লাগবে…হাতে রাখুন। এগিয়ে চললাম দুজনে WBSFDA কে ডান হাতে রেখে। একটু কুকুর বেশ কিছুটা পথ আমাদের অনুসরণ করলো। আমি মাঝে মাঝেই পিছিয়ে পড়ছিলাম আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছবি তুলতে তুলতে । একটু হেঁটেই চোখে পরে দুটি অন্য পাহাড়..লেদি আর সরপাহাড়ি। বিহারিনাথের ভৌগোলিক অবস্থানটা এখানে একটু বলে রাখি। বাঁকুড়া তে পড়লেও, বিহারিনাথকে ঘিরে আছে পুরুলিয়া আর ঝাড়খন্ড বর্ডার। এখানকার সামাজিক পরিকাঠামো টাও তাই মিশ্র। যাইহোক। প্রায় ১ কিমি হাঁটার পর রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ি জঙ্গলের পথ ধরলাম। বিহারিনাথের উচ্চতা ১৪৮০ ফিট , অবশ্য আমাদের পুরোটা ওঠার কোনো দোকান নেই। বেশ কিছু জায়গা অজিত কাকা লাঠি দিয়ে ঝোপঝাড় সরিয়ে এগোতে লাগলো, আমি পেছন পেছন। বর্ষার বিহারিনাথ এতটাই মনোরম, প্রত্যেকটি পদক্ষেপে যেন মন প্রাণ ভরে সবুজটা উপভোগ করছিলাম। লেন্স থেকে চোখ সরানোটাই যেন দায়। এবার চড়াই শুরু। কিছুটা উঠে একচিলতে পাহাড়ি ঝর্ণা চোখে পড়লো। জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি ওনার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার। পথ হারালে মুশকিল কারণ ওনার মোবাইল নেই। এভাবেই উঠে এলাম সেই মুনির আশ্রমে। পাহাড়ী জঙ্গল ভেঙে অনেকটাই ওপরে একটা কুঁড়ে ঘর। ওটাই আশ্রম। মুনি অবশ্য ছিলেন না তখন। তবে ওনার ওখানে থাকার সমস্ত অস্তিত্বই বর্তমান। জায়গাটা যেমন সুন্দর তেমনি রহস্যময়।  বন্য জীবজন্তু থাকা টা অসম্ভব কিছু নয়। আমি অবশ্য একটি লালমুখো গিরগিটি ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। এবার উৎরাই। ওখানে থেকে নেমে শুরু হলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই সমতলে হাঁটা। বেশ কিছুটা হেঁটে বুঝলাম এডভেঞ্চার এর নেশায় ঝক্কি টা একটু বেশিই নিয়েছি। ৯কিমি চড়াই উৎরাই শারীরিক ভাবে আমার জন্য খুব একটা মধুর হবে না! অবশ্য পরে বুঝেছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে থাকলে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়ে যায় নিজের অজান্তেই। দেখতে দেখতে এসে পড়লাম আদিবাসী গ্রাম, ময়সরডিহি গ্রাম। এক কথায় বলা যায় ফটোগ্রাফির স্বর্গ রাজ্য। আদিবাসী জীবন এবং তাঁদের রোজনামচা কিছুটা উপলব্ধি করলাম। এরপরের রাস্তা অনেকটাই সমতল। ধানি জমির আল দিয়ে হাঁটা শুরু হলো। পৌঁছে গেলাম উরেস্বরী মন্দির। এখানে বিগ্রহ অন্য রকমের। ছোট ছোট পোড়ামাটির ঘোড়া সিঁদুর পড়ানো। তার মাঝখানে একটি পাথর খন্ড। এবার ফেরার পালা। কতটা হাঁটা আরও সেটা কাকাকে জিজ্ঞেস করায় বললো এই একটুখানি। কাকার সেই “একটুখানি” অবশেষে শেষ হলো আরো ২ ঘন্টা হাঁটার পর!! পায়ে আমার আর কোনো সার নেই ততক্ষণে। সেদিন সন্ধ্যা তে শুধু রেস্ট।

৫:

ফেরার কোনো রেল reservation আমি করে যায়নি। প্ল্যান ছিল কোনোভাবে আসানসোল চলে এসে কলকাতার বাস ধরবো। বিকেল অব্দি ঘুমিয়ে বেরোলাম চায়ের সন্ধানে। চায়ের দোকানে বসে আসানসোল যাওয়ার একটি নতুন রুট আবিষ্কার করলাম। এইটা আমার জানাই ছিল না। সাধারণত সবাই ওখান থেকে আসানসোল ফেরে হয় শালতোরা – রানীগঞ্জ হয়ে। অথবা বিহারিনাথ থেকে মধুকন্ডা স্টেশন, সেখান থেকে লোকাল ট্রেন এ আসানসোল। তবে আসানসোলের ট্রেন মধুকন্ডা থেকে বেশ গ্যাপ এ। চা ওয়ালার কাছে জানলাম ওখান থেকে নদী ঘাট অব্দি অটো রিসার্ভ করে যাওয়া যাবে 100 টাকায়। এটা দামোদর নদের এপার। ওই পারটা বর্ধমান। ওই পার থেকে আসানসোলের বাস পাওয়া যাবে। পরদিন সকালে চেক আউট করে এই পথটাই নিলাম। এই পাড়ের শেষ গ্রাম হলো ঈশ্বরদা গ্রাম। নদী ঘাটে পৌঁছে আমি হতবাক। দামোদরের এমন রূপ আমার কল্পনার বাইরে ছিল। চওড়া অনেকটা। নদের মাঝামাঝি একটা জায়গা থেকে কাঠের সাঁকো শুরু হয়েছে। ওটাই পায়ে হেঁটে ওপারে পৌঁছতে হবে। সাঁকো অব্দি এদিকে জল নেই। শুকনো river bed। নদের তটে লালচে বালি অনেকটা যেন সমুদ্র তটের মত। বাঁকুড়ার দিকে চোখ ফেরালে  দেখবেন বিহারিনাথ পাহাড় তাকিয়ে আপনার দিকে, যেন আপনাকে বিদায় জানাচ্ছে দূর থেকে। নদের একেকটা জায়গা এখানে একেকরকম topography। বেশ কিছুক্ষন আমি river bed এ ঘুরে বেড়ালাম আর মনের সুখে ছবির বিভিন্ন angle খুঁজে বের করলাম। এরপর সাঁকো পেরিয়ে ওদিকে মিনিট পনেরো হেঁটেই বড় রাস্তা পেলাম। আসানসোলের বাস দাঁড়িয়েই ছিল। বাঁকুড়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিহারিনাথকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লাম। অনেক সবুজ, অনেক নতুন সত্তা, অনেক নিজেকে নতুন করে জানা নিয়ে ফিরে চললাম কলকাতা।।

© Arijit Kar

0 0 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: