১:
আমার নিজের জন্ম, শিক্ষা, কর্ম কোলকাতায় হলেও বাবার ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে উত্তরবঙ্গে, মূলত তরাই অঞ্চলের আঁচলে। রক্তের টানেই হোক অথবা নির্ভেজাল প্রকৃতির কোলে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যই হোক, ডুয়ার্স আমাকে সবসময় টানে।

View of dooars from train
তার ওপর যদি দিন তিনেকের কোনো টানা ছুটি পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। এবছরের দোলে আমার সেই মনোবাসনা পূরণ করতে ১লা মার্চ রাত্রে কাঞ্চনকন্যা ছুট লাগলো আমায় নিয়ে। যতবার এই ট্রেনে উঠেছি মনটা আকুল হয়ে থাকে কখন পরদিন সকালে শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে ম্যাল এর পথে এগুবো।

Journey towards Raimatang tourist spot
এবারেও এর ব্যাতিক্রম হলো না। রেল লাইনের পাশের ছোট ছোট গ্রামগুলির কাঠের বাড়িগুলি একেক করে মিলিয়ে গেল দুপাশের গভীর অরণ্যে। বসে থাকা দায় সেই অরণ্যের টানে। ক্যামেরা হাতে চলে এলাম দরজায়। অরণ্যের নিয়ম মেনে মন্থর গতিতে এগিয়ে চললো কাঞ্চনকন্যা।

A stream spotted from train

Wonderful beauty of dooars from train
একেক করে চালসা, দলগাঁও, হাসিমারা ছাড়িয়ে প্রায় ১২ টার কাছাকাছি নামলাম হ্যামিলটনগঞ্জে।

Beautiful views after Mall junction

View of tea gardens from the train
২:
রায়মাটাং মাউন্টেন ভিউ হোম স্টের অমৃত ছেত্রী বলা সত্ত্বেও আগেরদিনই আমি বলে দিয়েছিলাম গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে দেখি অটো, ম্যাজিক বা অন্য গাড়ি কিছুই নেই। একটি সিগারেটের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম আজ হোলি তাই সব বন্ধ। এদিকে অমৃতের ফোনও সুইচড অফ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কালচিনির একটি শেয়ার অটো পেয়ে উঠে পড়লাম। কালচিনিতে নেমে অন্য একটি অটোর সাথে দরদস্তুর করে ঠিক করলাম ৩০০ টাকার বিনিময়ে সে রায়মাটাং যাবে। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ভাটপাড়া চা বাগান এবং কালচিনি চা বাগান আর তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। রায়মাটাং নদীর কাছে যখন পৌঁছলাম তখন মেঘলা আকাশ। রায়মাটাং গ্রামে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা হলো এই নদীর রিভার বেড দিয়েই। বর্ষার কয়েক মাস ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এই নদী এবং ওই কয়েক মাস রায়মাটাং গ্রামটি সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। বর্ষার আগেই সেই কয়েক মাসের রেশন গ্রামবাসীরা ঘরে মজুত করে রাখেন।রূপালী নুড়ি পাথর বিছানো রিভার বেড। কিছুটা এগিয়েই অটো গেলো থমকে।

Dry river of Raimatang
পেছনের একটি চাকা কাদায় গেঁথে গেছে। ভুটান পাহাড়ে শুরু হয়ে গেছে তুমুল বৃষ্টি। শুকনো রিভার বেড আর শুকনো নেই, ছোট ছোট ধারায় রায়মাটাং কিছুটা কর্দমাক্ত। স্থানীয় কিছু ছেলের সাহায্য নিয়ে চাকা তোলা হলো বটে কিন্তু ড্রাইভার আর এগোতে নারাজ। সৌভাগ্যক্রমে একটি ম্যাজিক গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। অটো ওয়ালা এগিয়ে গিয়ে গাড়িটি থামিয়ে কি কথা বললো জানিনা, তবে ফিরে এসে যখন বললো ব্যবস্থা হয়ে গেছে বাকি রাস্তাটা ম্যাজিক আমাকে পৌঁছে দেবে…বেশ আস্বস্ত হলাম। কিছুদূর গিয়ে ম্যাজিকের ড্রাইভারের প্রশ্নে চমকে উঠলাম -“আপ মন্দির জাওগে তো? ইঁয়াহ সে পেয়দাল যানা হোগা আপকো।”
বলে কি লোকটা? কোন মন্দির! ঠিক যে জায়গাটায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে সেখানে রায়মাটাং নদী প্রায় ১ কিমি চওড়া। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে নদী। দুপাশে শুধুই পাহাড়ী অরণ্য। ওদিকে ঝিরঝির করে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। আমার অবস্থা দেখে ড্রাইভার বুঝলেন যে তাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে চম্পট দিয়েছে অটো ওয়ালা। হয়তো তাঁর সহানুভূতি হলো আমায় দেখে। গাড়ি নিয়ে রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পৌঁছে দিলেন অমৃতের মাউন্ট ভিউ এর সামনে।

Mountain View homestay of Amrit
৩:
ছিমছাম একটি গ্রাম। জনসংখ্যা ৯৫। এরমধ্যে ৪ টি বাড়িতে হোম স্টে করা হয়েছে। সবকটি বাড়িই উঁচু কাঠের পিলার বা গাছের গুঁড়ি বা কংক্রিটের পিলার এর ওপরে কাঠের কাঠামো।

Palm trees surround the Raimatang village
আমার বাড়িটি ঠিক যেন ছোটদের পেন্সিল রং করার বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একটি ছবি। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই চওড়া বারান্দা, তার লাগোয়া পাশাপাশি দুটি ঘরের একটিতে আমার ঠাঁই। অমৃতের বিনয় আর বাড়িটির অবস্থান দেখে মন ভরে গেলো। ৩৬০° এঙ্গেলে পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা এই গ্রাম।

Beautiful village of Raimatang with wooden houses
বক্সা টাইগার রিসার্ভ এরই বাফার জোনে পরে এই রায়মাটাং গ্রাম। সামনের সবুজে মোড়া পাহাড়ে গুলোর মাথা ছাড়িয়ে দূরে উকিঁ দিচ্ছে ভুটান পাহাড়। সামনেই সুপারি গাছের বাগান আর তার ওপারে অরণ্য মহল গেস্ট হাউস। অমৃতের বাড়িতে থাকা খাওয়া সমেত মাথা পিছু ১২০০ টাকা ভাড়া দিন প্রতি। গত রাত থেকে লোডশেডডিং তবে হালকা ঠাণ্ডার প্রলেপ থাকাতে অসুবিধা নেই। লাঞ্চ করতে করতে শুনলাম গত ১০ দিন ধরে রোজ এই গ্রামে হাতি আসছে চালতা খাওয়ার লোভে। কখনো ৯টি হাতির একটি পাল আবার কখনো অর্ধেক লেজ ওয়ালা একলা একটি হাতি। অমৃতের কথায় এই সিঙ্গেল হাতিটি “বড়া বদমাশ”। বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ৩টে। ঠিক করলাম বিকেলে আকাশ বলে যে কেয়ারটেকার টি আছে, তাকে নিয়ে রিভার বেড টা একটু ঘুরে আসবো। ঘন্টা খানেক পরে বেরোতে গিয়ে শুনলাম রিভার বেডের দিকে হাতি বেরিয়েছে, যাওয়া টা ঠিক হবে না। অনেক কষ্ট করে রাজি করালাম তাকে, শর্ত হলো সমতল রাস্তা দিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক তাই খাড়াই পাথুরে রাস্তা ধরে যেতে হবে। তাই সই। গ্রামের পথ ছেড়ে ধরলাম চড়াই রাস্তা। রাস্তা বলা ভুল, এক চিলতে পথ পাহাড়ী অরণ্যের ফাঁকে।

The uphill trek in the evening to avoid elephants
প্রতি ১০০ মিটারে দেখি হস্তী বিষ্ঠা। এই রাস্তা তো মনে হচ্ছে আরও বিপজ্জনক! জানতে চাওয়াতে আকাশ বোঝালো সমতলে হাতির সাথে দৌড়ে পারা অসম্ভব, তবে পাথুরে রাস্তা উনারাও নাকি একটু সম্ভ্রম করেন। সে যাই হোক অন্ধকার হওয়া অবধি এখানে থাকার আর সাহস হলো না। ফিরে এলাম।

Glimpse of Raimatang river after an uphill trek

Flower garden at Amrit’s homestay
সন্ধ্যা হতেই পুরো গ্রামটা ঝিমিয়ে পড়লো। থেকে থেকে জঙ্গল থেকে প্রতিধ্বনি আসছে ময়ুরের কর্কশ ডাকের। অমৃতের সাথে গল্প করতে করতে একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো। মাঝে মাঝেই একেকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে টর্চের তীক্ষ আলো। কয়েক সেকেন্ড এলোমেলো ভাবে সেই আলো ঘোরাফেরা করে আবার সব শান্ত। মানুষের জনবসতি ঠিক কোন জায়গায় আছে এইভাবেই জানান দেওয়া হয় হাতিদের যাতে করে একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে না পড়েন তেনারা। হাওয়ায় একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, দূরে বৃষ্টি হচ্ছে বোঝাই যায়। একটা তীব্র গন্ধ নাকে এলো। এই গন্ধ আমার চেনা। মাঠাবুরুর পাহাড়ে ওঠার সময় এই গন্ধ পেয়েই আমরা হনহনিয়ে নিচে নেমে এসেছিলাম হাতির ভয়। এ গন্ধ কি তবে সেই গন্ধ? দেশলাই জ্বালিয়ে হাওয়াটা কোনদিক দিয়ে আসছে বোঝার চেষ্টা করলাম। দিক নির্দেশ পেলাম গন্ধটা ভেসে আসছে রিসোর্টের পেছনদিকে দূরে কোথাও থেকে। তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই গন্ধটা আর পেলাম না। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম ১১.৩০ টা নাগাদ। ঠিক পৌনে বারোটা নাগাদ দূর থেকে একটা কিসের যেন চেঁচামেচির আওয়াজ পেলাম। ঠিক তার পরক্ষনেই দরজায় টোকা এবং অমৃতের গলার স্বর – “স্যার। হাতি নিকলা হেই।” একলাফে কম্বল সরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি আমার ঘরের লাগোয়া ডান দিকের রাস্তাটিতে হেলে দুলে এগোচ্ছে ঐরাবৎ! তার পেছন পেছন একদল লোক বিভিন্ন গলার আওয়াজে আর পটকা ফাটিয়ে তাকে খেদানোর চেষ্টা করছে জঙ্গলের দিকে। মেঘে ঢাকা জ্যোৎস্নার ক্ষীণ আলো, টর্চ আর হাতের মশাল এর আলোতে ছবি তোলা সম্ভব নয় তাই শুধুই দু চোখ ভরে উপভোগ করলাম সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। কয়েক মিনিটের দৌড়াদৌড়ি আর উৎকণ্ঠা। তার পরেই আবার সব যেমন ছিল তেমন। যেন হঠাৎ এসে চলে যাওয়া একটি দুঃস্বপ্ন। বুঝলাম গন্ধটা মিথ্যা ছিলো না।
৪:
আজ দ্বিতীয় দিন। প্ল্যান ছিল অমৃতের বাইকে যতটা যাওয়া যায় রিভার বেড ধরে গিয়ে বাকিটা হেঁটে যাবো মহাকাল দর্শনে। বাধ সাধলো সেই হাতি। ভোরের দিকে রিভার বেড লাগোয়া জঙ্গলে তাদের আগমন। অতএব বাইকের বদলে টাটা সুমো নিয়ে এগোলাম রিভার বেড ধরে। গত রাত্রে বৃষ্টি হওয়াতে আশপাশের সবুজ আজ বেশ গাঢ়। শুকনো রিভার বেডে গাড়ির চলাচলের দাগ থাকে আর তাই অনুসরণ করে যাওয়া সহজ। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার ফলে সেই চাকার দাগ নিশ্চিহ্ন। বেশ বেগ পেতে হলো ড্রাইভারকে। ছোট ছোট জলের ধারা আর এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রিভার বেড ধরে ১ কিমি গিয়ে আর এগোনো সম্ভব হলো না।

Trekking through Raimatang river bed
অমৃতকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা লাগলাম। যত এগোচ্ছি নুড়ি পাথরের বদলে জায়গা নিচ্ছে বিভিন্ন রঙের বড় বড় বোল্ডার। এই উঁচু পাথর গুলোর ওপর দিয়েই পথ তাই খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হচ্ছে। মাঝখানে অজস্র জলের ধারা, ডিঙ্গিয়ে কখনো বাঁ দিক ঘেঁষে কখনো ডান দিক ঘেঁষে এগোচ্ছি।

Amrit guiding me over rocky river bed of Raimatang

River stream through the rocks
অমৃত চোখ রেখে চলছে দুপাশের ঘন জঙ্গলে খুব সতর্ক হয়ে। সমস্ত রাস্তায় ইতিউতি ছড়িয়ে আছে হস্তী বিষ্ঠা। পুরো রায়মাটাং টাই যেন তেনাদের অবাধ বিচরণ কেন্দ্র।

Elephant excrete at Raimatang river bed

Fallen trees lie all over the river bed

A person selling some puja materials for Mahakal temple visit
সমতল ছেড়ে পথ চড়াই হচ্ছে কারণ রায়মাটাং যেদিক থেকে নেমেছে আমরা সেদিকেই হাঁটছি। প্রায় ৩ কিমি ট্রেক করে আমরা পৌঁছে গেলাম মহাকালের গুহাতে। পাথরের খাঁজে ছোট ছোট গহ্বর। আর সেখানেই পূজিত হচ্ছেন মহাদেব। বেশ কয়েকজন স্থানীয় লোক চোখে পড়লো যাঁরা পূজো দিতে এসেছেন।

Uphill trekking to Mahakal temple

Mahakal temple at Raimatang

Shiva at Mahakal temple
ছেড়ে যেতে মন চায়না। কিসের যেন মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গেলাম ওই রঙবেরঙের পাথর গুলোয় আর দুপাশের সবুজ বনানীতে। ফেরার পথে রিভার বেড টায় অনেক্ষন ঘুরেফিরে তবে আশ মিটলো।

Dry river bed while returning from Mahakal temple

Twigs collectors returning after collection from the forest

Local children sitting on a rock top at Raimatang river
৫:
বিকেলে আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের অন্য ভাগটায়। ১ কিমি পথ পেরিয়ে আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এদিকটায় অরণ্যের অন্য রূপ। শালের জঙ্গলের মাঝে বিছানো শুকনো ঝরা পাতার গালিচা। গা ছমছমে পরিবেশ। মাথার ওপর ঘন সুবুজের আচ্ছাদন ভেদ করে শেষ বেলার আলো ঢুকতে অনেকটাই ব্যর্থ।

Carpet of dry leaves spread over Raimatang forest

Akash with his cookrie at Raimatang forest
আকাশ চলেছে কোমরে একটি বড় কুকরি ঝুলিয়ে আমার পথপ্রদর্শক হয়ে। পাখির কলরবে মুখরিত চারিদিক। থেকে থেকে কানে আসছে পিলে চমকানো ময়ুরের ডাক। বাঁ পাশের জঙ্গল থেকে হঠাৎ ডালপালা ভাঙ্গার একটা মচমচ আওয়াজে দুজনের পা থমকে গেলো। ভালো করে দেখে আকাশের স্বগতোক্তি – “বান্দর হে”। ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছে দেখি জীর্ণ একটি কাঠামো। লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপর অবধি।

Abandoned watch tower at Raimatang forest
৯০% সিঁড়ির ধাপগুলোর কাঠের পাটাতন নেই, আর যেকটির আছে সেগুলোর জন্য আকাশের সতর্কবাণী – ” স্যার, কাঠ মে পাও মত রাখিয়ে গা। কভি ভি ও টুট সকতা হে!” অর্থাৎ প্রতিটি ধাপে পা এমনভাবে রাখতে হবে যাতে সরু লোহার কাঠামোর ওপরেই পা টা থাকে। ১ ইঞ্চি সরু সেই লোহার পাত গুলোর ওপর ভারসাম্য রেখে উঠে এলাম ওপরে।

Broken iron stairs of the watch tower
সামনেই জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে উকিঁ দিচ্ছে একটি ছোট শুষ্কপ্রায় জলাশয়। গাঙ্গুটিয়া নদী থেকে এই জলাশয়ের উৎপত্তি। বন্যপ্রাণীরা মাঝে সাঝে এখানে আসে জল খেতে। গত সপ্তাহে গ্রামের একটি বাছুরের আধখাওয়া দেহ পাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। গ্রামবাসীর মতে এই কম্ম লেওপার্ড এর। হাতি, লেওপার্ড, বুনো শুয়োর, বাইসন, সজারু এবং অজস্র পাখির বাস এই অরণ্যে।

Sunset at Raimatang forest
ফেরার আগের দিন রাত্রে সাধারণত মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। তবে এইবারটা তার ব্যতিক্রম। সন্ধ্যাটা জমিয়ে রাখলেন গানে গল্পে ভ্রমণ আলোচনায় আজ দুপুরে আসা দুজন ট্যুরিস্ট। পেশায় এনারা শিক্ষক।

Dreamy night of Raimatang village
৬:
আজ ফেরার পালা। ব্রেকফাস্ট করে অমৃতের সাথে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম পোখরি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরা হলো।
একটি গাড়ি কোনোরকমে চলতে পারার মতো রাস্তা। দুপাশের ঘন অরণ্য ঘাড়ের উপর যেন উপচে এসে পড়ছে তার নিজস্ব এক ঘ্রান নিয়ে। এ অরণ্যের পরতে পরতে যেন এক রহস্যের হাতছানি। গতকাল এই জঙ্গলেই হরিণ আর ময়ূর দেখেছিলেন সাফারী করতে এসে রিসোর্টের অপর দুই ট্যুরিস্ট। ময়ূরের ডাক আমিও পাচ্ছি বটে তবে শুনেই বোঝা যাচ্ছে তা আসছে অনেক দূর থেকে। দুপাশে চোখ রেখে এগিয়ে চলেছি।

Driving towards Pokhari village through the forest
বেশ কিছুটা গিয়ে পাহাড়ী পাকদন্ডী রাস্তা নিলাম আমারা। বুঝলাম আমরা পোখরি পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছি। গাড়ির রাস্তা যেখানে শেষ সেইখান থেকে হাঁটা পথ প্রায় আরো ১ কিমি। গাড়ি থেকে নেমেই নীল আকাশে উড়ে যাওয়া দুটি হর্নবিল বা ধনেশের অভিবাদন পেলাম। কিছুটা চড়াই উঠে পৌঁছে গেলাম পোখরি গ্রাম।

Pokhari village

A village hut while trekking to Pokhari lake
পাহাড়ের ওপর টেবিল টপের মতো এক টুকরো সমতল আর তাতেই কয়েক ঘর নিয়ে এই ছোট্ট গ্রাম। এখানেও একটি হোম স্টে তৈরী হচ্ছে। গ্রাম ছাড়িয়ে আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই উতরাই পেরিয়ে একটি পুকুরের সামনে চলে এলাম।

Trekking route from Pokhari village to Pokhari lake
এটাই পোখরি লেক নামে পরিচিত। স্থানীয় মানুষের কাছে খুব পবিত্র এই লেক। অজস্র মাছের নির্বিঘ্নে বিচরণ তার জলে কারণ এই স্থানীয় মানুষের কাছে এই পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া পাপ। মানুষ এখানে আসেন মুড়ির প্যাকেট নিয়ে মাছেদের খাওয়াতে এবং পূজো করতে। চারদিকে পাহাড়ের মাজখানে কি করে যে এই পুকুরের সৃষ্টি তা আজও বিস্ময়।

Pokhari Lake

Peace flags over Pokhari lake
পুকুর পাড়ের পাথরগুলোতে চুপচাপ বসে থাকার এক অদ্ভুত প্রশান্তি। ঘন্টার পর ঘন্টা ডুব দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে সেই প্রশান্তিতে। সময় বাধ সাধলো।
৭:
ফিরতি পথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অন্য রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তা গিয়ে পড়েছে গাঙ্গুটিয়া নদীতে। নদীর রিভার বেড পেরিয়ে কালচিনি যাওয়ার আরেক রাস্তা। জঙ্গলের পথে পড়লো ওয়াচ টাওয়ার। এখানে বনদপ্তরের কর্মীদের ২৪ ঘন্টা পোস্টিং। সাধারণের জন্য অবশ্য এই ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার কোনো অনুমতি নেই। ওয়াচ টাওয়ারকে পেছনে ফেলে কিছুটা এগোতেই দেখি আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার ওপর একটি গাছ উপড়ে পরে আছে।

Uprooted tree at Raimatang forest
অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ওয়াচ টাওয়ারের দিকে এগোচ্ছি। হঠাৎ বাঁদিকে একেবারে কাছ থেকে ময়ুরের আওয়াজ। অমৃতকে বললাম ধীরে ধীরে গাড়িটি ব্যাক গিয়ারে নিয়ে পিছতে। এবার বিফল হলাম না। বাঁহাতে কিছুটা দূরের একটা গাছের ওপর পেখম ঝুলিয়ে বসে আছে ময়ূরটি।

Sighting a peacock at Raimatang forest
অমৃতের কথায় – “আপকা নসীব মে য়ে থা, ইসি লিয়ে সায়েদ রোড ব্লক হো গেয়া থা।” সত্যিই হয়তো তাই! অমৃত ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে বনকর্মীদের শরণাপন্ন হতে তাঁদের একজন প্রকান্ড একটা লোহার করাত নিয়ে উঠে পড়লো গাড়িতে।

With forest guards at Raimatang forest
গত রাত্রে হাতির পাল যাওয়ার সময় গাছটি উপড়েছে আর তার প্রমান স্বরূপ আবার গাছের উপর ভাগটার ঠিক নিচে ত্যাগ করে গেছে তাদের বিষ্ঠা। করাতটি দুজনে মিলে ধরতে হয় এবং ভয়ঙ্কর ধারালো। অমৃত আর সেই বনকর্মী ৩-৪ মিনিটে গাছটি কেটে রাস্তার ওপর থেকে সরিয়ে দিলো। আবার যাত্রা শুরু।

Amrit and forest guards cutting the uprooted tree with big saw
অরণ্য ছাড়িয়ে এসে পড়লাম গাঙ্গুটিয়া বসতিতে। সেই গ্রাম ছাড়িয়ে গাঙ্গুটিয়ার রিভার বেড পার করে ওপারে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা।

Kalchini tea garden
কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কালচিনি। আজ গম গম করছে কালচিনি অটো আর ম্যাজিকের দৌরাত্বে। আলিপুর দুয়ারের শেয়ার অটো পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। একপাশে চা বাগান আর অন্য পাশে ট্রেন লাইন। তারমধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে অটো।

Road through Kalchini tea garden
রাজাভাতখাওয়া হয়ে বক্সার ধার ঘেঁষে মিনিট ৪৫এ আলিপুর দুয়ার পৌঁছে ওখান থেকে টোটো নিয়ে সোজা নিউ আলিপুর দুয়ার স্টেশনে যখন নামলাম পদাতিক ছাড়তে তখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। মনটা পরে থাকলো অমৃতের ছোট্ট গ্রামটায়, ওদের বাড়ির পাশের সেই যে আঁকাবাঁকা অরণ্যের পথ…সেই পথটায়, ময়ূরের ডাকের সেই প্রতিধ্বনি গুলোতে, কুয়াশার চাদর সরিয়ে একটু একটু করে ঘুম ভাঙ্গা ভুটান পাহাড়ে, রায়মাটাং নদীর সেই রূপালী রিভার বেডে আর সেই অজানা অরণ্যের বন্যতায়।
© Arijit Kar

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.