ঝিলিমিলি ঝিল্লি
১:
কেন্দুয়াবাড়ি পাখিরালয় স্টপেজে যখন ট্রেকার টি আমায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো আশপাশে একটি মুদির দোকান ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। দোকানটির পাশ দিয়ে মোরামের রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভেতর। এটুকুনি বুঝলাম যে এই মোরামের রাস্তাই আমায় গন্তব্যে পৌঁছে দেবে কিন্তু ৫ মিনিট দাঁড়িয়েও কোনো অটো বা নিদেনপক্ষে কোনো সাইকেল ভ্যানেরও দেখা পেলাম না। এদিকে কারু কে ফোন করেও শুধু “দেখছি কিছু পাই কি না” মার্কা উত্তর ছাড়া আর কিছু পেলাম না। কারু ঝিল্লি পাখিরালয়ের কেয়ারটেকার। সকাল ৯.১৫ তে ইস্পাত ঝাড়গ্রামে নামানোর পরেই কারুর ওপর আমার ভরসা উড়ে গেছিলো যখন বাস স্ট্যান্ডে এসে শুনলাম যে হাতিবাড়ির বাস ডাইরেক্ট নেই। গোপীবল্লভপুর হয়ে ভেঙে যেতে হবে। অথচ এই কারুই আগের দিন আমায় ফোনে আশ্বাস দিয়েছিল পর পর নাকি ঝাড়গ্রাম থেকে হাতিবাড়ির বাস আছে। ঝাড়গ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর ৪১ কিমি বাসে, সেখান থেকে ঝিল্লি আরো ২৪ কিমি ট্রেকারে। হাতিবাড়ির ২ কিমি আগেই নেমে এই কন্দুয়াবাড়ি মোড়। সে যাই হোক, আমার অসহায়তা দেখে মুদির দোকানের মালিক নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর অটোওয়ালা কাকা কে ডেকে দিলেন।
২:
মোরামের রাস্তা ধরে অটো এগোতেই মনের ভেতর দলা পাকিয়ে আসা বিরোক্তিটা এক ধাক্কায় কর্পূরের মতো উবে গেলো। দুপাশে গাঢ় সবুজে খচিত মিষ্টি একটা গ্রাম। মাটির ঘর আর তার নিকোনো উঠোনে অলস দুপুর কাটানো কিছু সরল মানুষ। পথে দেখা হয়ে গেল কারুর সাথে, সে তখন হাতিবাড়ি যাচ্ছে। আস্বস্ত করলো আমাকে যে পাখিরালয়ে তে আমার থাকার সব ব্যবস্থা হয়ে আছে…গিয়ে পৌঁছলেই হলো।গ্রামের পরেই পলাশের জঙ্গল আর ডান হাতে সুবিশাল ঝিল্লি হ্রদ।

Jhilli bird sanctuary lake
হ্রদের অপর প্রান্তে দেখা যাচ্ছে পাখিরালয়ের ঝকঝকে জোড়া কটেজ। সমস্যাটা হলো পাখিরালয়ের প্রবেশদ্বারটি হ্রদের একেবারে অপর প্রান্তে, তাই আরও ৪ কিমি জলাশয় টিকে চক্কর মেরে পৌঁছতে হলো। বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ২টো।বয়স্ক একজন কর্মচারী আমায় যে কটেজ টিতে নিয়ে ঢোকালেন, তা বাসের অযোগ্য। বোঝাই যায় সেটি এখনো গেস্টদের জন্য চালু হয়নি। দেখে তো আমার মেজাজ সপ্তমে। পঞ্চায়েত সমিতির কোনো এক সদস্য নাকি সপরিবারে হঠাৎ করে চলে এসেছেন বনভোজনে তাই আমার জন্য বরাদ্দ কটেজ টি কিছুক্ষনের জন্য ওনাদের দিতে হয়েছে, ওনারা ৪টের মধ্যে ঘর ছেড়ে দেবেন…তখন ওই ঘরটি আমি পেয়ে যাবো।
৩:
ভাগ্যিস লাঞ্চটা গোপীবল্লভপুরে নেমে সেরে নিয়েছিলাম। মাথাটা ঠান্ডা করার জন্য ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কটেজের অবস্থানটা বড়ই সুন্দর। বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে নেমে কয়েক পা এগোলেই জলাশয় তিনদিকে ঘেরা। কটেজের দিকে পেছন করে সামনে তাকিয়ে মনে হলো কোনো এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে আমি। পাখিরালয়ের চত্বরটা বেশ বড়। বাগান দিয়ে সাজানো। দ্বিতীয় কটেজটির ( যেটি আমি ৪টের পর পাবো) সামনে দেখি বাঁধানো একটি ঘাট আর তাতে একটি প্যাডেল বোট বাঁধা। একটু হাঁকডাক করতেই একটি অল্পবয়সী ছেলে উদয় হলো। হ্রদটি চোষে বেড়ানোর এটিই একমাত্র যান এখানে। অতএব ছেলেটিকে নিয়ে ভেসে পড়লাম ঝিল্লির জলে পাখির খোঁজে। পুরো হ্রদটি ছেয়ে আছে শাপলা ফুলে। আধডোবা বড় বড় পাতাগুলো থেকে গলা উঁচিয়ে সারী সারী গোলাপী ফুলগুলো যেন আমাকেই অভিবাদন জানাচ্ছে।

Shapla and shaluk on the lake at Jhilli bird sanctuary

Sunset on the Jhilli lake
পার ছেড়ে একটু গভীরে যেতেই কানে এলো মিহি শীষের আওয়াজ। চোখে পড়লো ঝাঁকে ঝাঁকে Lesser Whistling Duck.

Flock of lesser whistling ducks
সমস্যা হলো একটাই। প্যাডেল বোটটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করে নিজের উপস্থিতি অহেতুক জাহির করায় পাখিগুলির খুব কাছাকাছি যেতে আর সক্ষম হলাম না। ঝিল্লির জলে তখন কে যেন এক মুঠো গাঢ় কমলা রং গুলে দিয়েছে। সেই রঙে ঢেকে গেছে সারা আকাশ। শাপলার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যাস্তের এই রং বড় মোহময়।

Golden hour on the lake during sunset at Jhilli
৪:
ডাঙ্গায় ফিরে ভদ্রস্থ কটেজটা পেয়ে গেলাম। ট্যুরিস্ট বলতে তখন পুরো পাখিরালয় তে আমি একা। সান্ধ্য আহারের জন্য মুড়ি আর চপ আসতে এক ঘন্টা লেগে গেল! পরে শুনলাম কারু মহাশয় ঝিলের ওপার থেকে চপ মুড়ি বোটে করে এপারে পাঠিয়েছেন।

Day ends over the Jhilli lake
বুঝলাম দুপুরের ধ্যাতানি খাবার পরে তাঁর আর আমার সম্মুখে উদয় হওয়ার কোনো বাসনা নেই। সারাদিন যা ধকল গেছে তাতে রাত্রের ঘুমটা বেশ ভালোই হলো। সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম পাখিরালয়ের মূল ফটকের বাইরে। মোরামের রাস্তা না ধরে দেন দিকের হ্রদ লাগোয়া জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালাম কারণ কাল নৌবিহারের সময় মনে হয়েছিল এপাশটাতেই পাখিগুলোর আনাগোনা বেশি।

Bronze winged jacana
ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে কিছুটা এগোতেই বুঝলাম আন্দাজ টা ঠিকই করেছি। অজস্র বালিহাঁস ছাড়াও চোখে পড়লো শালুক পাতায় লুকোচুরি খেলে বেড়ানো কয়েকটি Bronze Winged Jacana. সকালের ঝকঝকে রৌদ্রে শাপলা ভরা ঝিল্লিতে বেশ লাগে পাখি দেখতে।

Flying Jacana

Jacana playing on the large water lily leaves
৫:
পাখিরালয়ে ফিরে একেবারে চেকআউট করে বেরিয়ে গেলাম কালকের সেই অটোতেই। কেন্দুয়াবাড়ি মোড় থেকে ২ কিমি গিয়ে পেয়ে গেলাম হাতিবাড়ি ফরেস্ট বাংলো। সুবর্ণরেখার ধারে একটুকরো বনানীর মধ্যে এই হাতিবাড়ি। বাংলোটিকে চারদিক দিয়ে ঘিরে আছে অরণ্য আর তার মাঝখান দিয়েই রাস্তা নেমে গেছে সুবর্ণরেখা নদীর পারে।

Kudrum flowers near Jhilli

The beautiful Subarnarekha river
থাকার জন্য অসামান্য পরিবেশ। খারাপ লাগলো একটাই যে এখানেও পিকনিক পার্টির যথেচ্ছ বিচরণ যার ফলে এই অরণ্য পরিবেশ কিছুটা হলেও কলুষিত হচ্ছে। সুবর্ণরেখা চুম্বকের মতন আটকে রাখলো পা দুটো আমার বেশ কিছুক্ষণ। এতটা চওড়া আর ঘন নীল সুবর্ণরেখা খুব কম জায়গাতেই চোখে পড়েছে আমার। বেরিয়ে আমরা এগোলাম ওড়িশা – ঝাড়খণ্ড – পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার এর দিকে। হাতিবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে খুব কাছেই এই বর্ডার। তিন রাজ্যের সংযোগ স্থলই বটে! আশপাশের দোকানপাট গুলোতে কোনোটায় বাংলা, কোনোটায় হিন্দী আবার কোনোটায় ওড়িয়া ভাষায় লেখা। বাসের দেখা পেলাম না তাই গোপীবল্লভপুরের ট্রেকার এই উঠে বসলাম। একই পথে ফিরে চলা। আফসোস একটাই রয়ে গেল মনে। কোথাও যেন একটু অবজ্ঞার সুর রয়ে গেছে ঝিল্লি পাখিরালয়ে। কর্তৃপক্ষের আরেকটু তত্ত্বাবধানে ঝিল্লি এবং হাতিবাড়ি সত্যি এক দারুন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।

Subarnarekha river from Hatibari Forest Rest House
© Arijit Kar

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.