চুপিসারে চুপির চরে
১:
বছর পাঁচেক আগে DSLR কেনার পর পরই এক সহৃদয় বন্ধুর সান্নিধ্যে এসে পাখি দেখা এবং পাখির ছবি তোলা নিয়ে একটু নেশাগ্রস্ত হই। আমার তখন শুধুই ১৮-১০৫ লেন্স। অতএব সেই বন্ধুর ৭০-৩০০ ধার করে ওর সাথে মাঝে মাঝে পাখির ছবি তুলতে যাওয়া…ওই অবধি। তারপর ও কোলকাতার বাইরে চাকুরিসূত্রে স্থানান্তরিত হওয়ায় আমারও লম্বা ভাঁটা পাখির নেশাতে। মাস ছয়েক আগে নিজেই মাথা গরম করে হঠাৎ কিনে ফেললাম Tamron ৭০-৩০০। যদিও পক্ষীবিশারদ যাঁরা, তাদের প্রিয় ৫০০মিমি+ , কাজ চালানোর জন্য আমার মত অনভিজ্ঞের কাছে এটাই অনেক। তবে হ্যাঁ, উঁচু গেছে বসা পাখি এটা দিয়ে সম্ভবপর নয়…তাই খুঁজে বেড়ানো এমন কোনো জায়গা যেখানে পাখিদের কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে। খুঁজে পেলাম এমনই এক জায়গা – পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী বা চুপির চর।
২:
শিয়ালদা থেকে সকাল ৮.০৬ এর কাটোয়া লোকাল ধরে পৌনে তিন ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম পূর্বস্থলী। নেমে কাষ্ঠশালী বাজারের ওষুধের দোকানের খোঁজ করতে বুঝলাম নবী বকস (9732142362) কে সবাই চেনেন। ঝকঝকে পরিষ্কার পরিছন্ন একটি গ্রাম…পরিযায়ী পাখিদের আসা, তাদের কাছেও যেন এক উৎসব। নবীদার গেস্ট হাউসের দোতলার ঘরটি কোলকাতা থেকেই বুক করে রেখেছিলাম। ৪০০/- টাকা ভাড়া। ওষুধের দোকানেই নবীদাকে পেয়ে গেলাম। চুপির চরে পাখিদের আনাগোনা, সঠিক স্থান এবং সময় সম্পর্কে ভদ্রলোকের ধারণা বেশ ভালো। নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বললেন ১.৩০ নাগাদ বেরিয়ে ছাড়ি গঙ্গা চলে যেতে, বিকেলের দিকে ওদিকটায় অনেক পাখি আসে। সেইভাবেই বোটম্যান কে বলে রাখলেন। নবীদার দোকান থেকে হোমস্টে হেঁটে ২-৩ মিনিট। গিয়ে বুঝলাম যাঁদের কাছে ঘরটা একটা খুতখুঁতনির বিষয়, তাঁদের এখানে না থাকাই ভালো। পরিবর্তে তাঁরা বুক করতে পারেন “পরিযায়ী আবাস” অথবা “কাষ্ঠশালী বনবীথি” ।আমার কাছে অবশ্য মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হলেই হলো।

At Purbasthali Bird Sanctuary ghat
৩:
১.৩০ র মধ্যে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম। খুব কাছেই ঘাট। আমবাগানের মধ্যে দিয়ে একটি শর্টকাট রাস্তা নিলাম। ঘাটে পৌঁছেই একরাশ মুগ্ধতা। নীলচে কালো সুবিশাল জলরাশি আর তার ফাঁকে ফাঁকে উকিঁ মারছে টুকরো টুকরো সবুজ , যেন ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ। সুদূর উত্তর-পূর্বে মায়াবী হাতছানি দিচ্ছে মায়াপুরের ইসকন মন্দির।

Boat waiting at the ghat

View of Iskcon temple fromChupir Char
গঙ্গার বয়ে যাওয়ার পথে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৩ কিমি ব্যাপ্ত এই অক্সবো হ্রদ। অবশ্য হ্রদের লাগোয়া চ্যানেল গুলো ধরলে, প্রায় ১১কিমি ব্যাপ্তি চুপির চরের। ঘাটে ৩-৪ টি নৌকো বাঁধা। সেগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই টি শার্ট এবং প্যান্ট পড়া একটি মাঝি এগিয়ে এসে বললো – “আমি লক্ষণ। নবীদা পাঠিয়েছে।” ১৫০/- টাকা করে ঘন্টা নৌকো ভাড়া। আর দেরী না করে ভেসে পড়লাম লক্ষণের সাথে। লক্ষণের সাথে দু এক কথা বলেই বুঝলাম লোকটি যে শুধু পাখি চেনে তা নয়, কখন কোথায় কোন পাখি দেখা যেতে পারে সে ব্যাপারেও বেশ আত্মবিশ্বাসী এবং তার সাথে ছবি তোলার জন্য কোন পজিশনে দাঁড়ালে সবথেকে ভালো আলো পেতে পারি সেই ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল।

My Boatman Laxman at Purbasthali Bird Sanctuary
৪:
পার ছেড়ে একটু এগোতেই চোখে পড়লো মাছ ধরার জাল আটকানোর বাঁশের ডগায় White Breasted Kingfisher এবং Cormorant।

White Breasted Kingfisher

Cormorant
যত এগোচ্ছি গভীরে ততো যেন জল স্বচ্ছ হচ্ছে। জলের নিচের উদ্ভিদগুলো পরিষ্কার দৃশ্যমান সেই স্বচ্ছ জলে। পাড়ের থেকে যেগুলো ছোট ছোট দ্বীপ মনে হচ্ছিল, এখন সেগুলোর কাছে গিয়ে বুঝলাম কিছু কচুরিপানা আর কিছু চর। তার মধ্যেই খেলে বেড়াচ্ছে Bronze Winged Jacana, Purple Swamphen, Pond Heron, Cristine Wagtail, Cotton Pigmy Goose এবং Wood Sandpiper।

Bronze Winged Jacana

Purple Swamphen

Pond Heron

Cristine Wagtail

Cotton Pigmy Goose

Wood Sandpiper
চুপির চরের মজাটা হচ্ছে যেহেতু আপনি নৌকোয় ঘুরছেন, পাখিগুলোর অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছনো যায় ইচ্ছেমত angel এ। দূরে পাড়ের কাছ বরাবর চোখে পড়লো গ্রামীন জল সেচের যন্ত্র।

Primitive irrigation mechanism
আর তার পাশেই বেশ কিছু সবুজ পাখি। লক্ষণ দূর থেকেই বলে দিলো Green Bee Eater।

Green Bee Eater with its catch

Green Bee Eater closeup
পূব দিকের আকাশে তখন শিস দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে Lesser Whistling Duck।

Lesser Whistling Ducks in flight
সেদিকপানে আমার বিস্ময় চাহুনি দেখে লক্ষণ আস্বস্ত করলো – “স্যার, সরাল অনেক পাবো। আগে চলুন Red Crested Pochard দেখে আসি।” লক্ষণ যে শুধু পাখির ব্যাপারে পারদর্শী তা নয়, এতো দেখি আমার মনের কথাও পরে ফেলছে! বেশ খানিকটা গভীরে এগিয়ে চললো লক্ষণ। সেই পথে দেখা মিললো সাদা ঠোঁট কপালে সাদা তিলক কাটা Common Coot এবং ছটফটে Little Grebe এর।

Common Coot

Little Grebe
কয়েকটি চর বেশ উর্বর। গ্রামের চাষীরা ডিঙ্গি নৌকো বেয়ে এসে সেখানে ক্ষেত খামারি করেন, এখন তাদের শেষ বেলায় বাড়ি ফেরার পালা। দেখা হলো এমনই এক চাষী পরিবারের দাদু নাতির সাথে।

A farmer on his dinghy boat returning after farming

The farmer with his grandson
প্রায় ৪ টে নাগাদ দেখা পেলাম বহু আকাঙ্খিত সেই অসম্ভব মিষ্টি পাখিটির। বিজয়ী হাসি হেসে তর্জনী তুলে লক্ষণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো – “স্যার। এই সেই Red Crested Pochard”। প্রাণ ভরে ছবি তুললাম।

Red Crested Pochards

Flying Red Crested Pochard

Two Male and one female Red Crested Pochard
শীতের বেলা, আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমরা ফেরার পথে এগোলাম। পথে দেখা হলো অজস্র Lesser Whistling Duck এর সাথে।

Flight of a Single Lesser Whistling Duck

A flock of Lesser Whistling Ducks again
পাড়ের কাছাকাছি ফিরতেই আকাশে তখন গোধূলির রঙের তুলির প্রথম টান। এবার নামলাম অন্য এক ঘাটে। এই ঘাটের একপাশে ওয়াচ টাওয়ার, অপরদিকে কাষ্ঠশালী বনবীথি এবং মাজখানে যতদূর চোখ যায় সর্ষে ক্ষেত।

Mustard Fields
সূর্যাস্তের শেষ রং গায়ে মেখে মাঝিদের ঘরে ফেরা দেখতে দেখতে আমিও ফিরলাম আমার অস্থায়ী আস্তানায়।

Day End

The Sunset at Purbasthali

The setting Sun
৫:
সিমেন্টের খাটের ওপর তোষক আর কম্বল দিয়ে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার সাথে রীতিমত লড়াই করে কোনোরকমে রাতটা কাটালাম। আজ যাবো বড় গঙ্গায়, সেইমতো লক্ষণ কে বলা আছে ৭ টায় বেরুবো। ৭.১৫ টা নাগাদ লক্ষণ ফোন করে জানালো একটু কুয়াশাটা না কমলে বেরিয়ে লাভ নেই, ছবি হবেনা।

Second day morning
অবশেষে সকাল ৮টা নাগাদ আমরা বেরোলাম। জলের ওপরে তখনও কুয়াশার আচ্ছাদন, দেখলে মনে হয় যেন ধোঁয়া উঠছে। এরই মধ্যে সুপ্রভাত জানালো ছোট্ট একটি Common Kingfisher, Pied Kingfisher এবং Gadwall।

Common Kingfisher

Pied Kingfisher on flight
গতকাল যে দিকটায় গেছিলাম আজ তার ঠিক বিপরীত দিকে আমরা এগোচ্ছি Ibis এর খোঁজে। আশপাশে চোখে পড়লো আরও কয়েকটি নৌকো, ভিউ ফাইন্ডার এ চোখ লাগিয়ে ওৎ পেতে বসে আছেন। এই পথেই লেন্সে একেক করে ধরা দিলো Open Bill Stork, Common Pochard, Red Crested Pochard, Barn Swallow, Pheasant Tailed Jacana, White Wagtail এবং Yellow Bittern।

More Red Crested Pochards

Open Billed Stork

Barn Swallow

Pheasant Tailed Jacana

White Wagtail
বেশ খানিক্ষন চলার পর অবশেষে দেখা মিললো Black Headed Ibis এর।

Black Headed Ibis
চুপির চরে প্রতিটি পাখির যেন নিজস্ব আলাদা আলাদা ঠিকানা আছে…ঠিক সেই চত্বরেই তারা সংসার পেতেছে। আর লক্ষণের মতো পটু মাঝিরা বা সঞ্জয় সিংহ র (9564642694) মতো গাইডদের ওই প্রত্যেকটি ঠিকানা নখদর্পনে। ঘড়িতে এখন ১০.১৫। এবার আমার একটি সরু খাঁড়ির পথ ধরলাম। এতটাই সরু যে কোনোরকমে একটি নৌকো যেতে পারবে।

Narrow Creek

Navigating a narrow creek
দুধারের গাছপালাগুলো নৌকোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এ যেন এক টুকরো amazonia আমার সামনে। উঁচু উঁচু ঘাসগুলো থেকে উকিঁ মারছে Long Tailed Shrike।

Long Tailed Shrike
খাঁড়ি দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে এসে পড়লাম মূল গঙ্গায়। নদী বেশ চওড়া এদিকটায়। লক্ষণ আমায় নামিয়ে দিলো ধূধূ বালির একটি চরে।অজস্র Pratincole খেলে বেড়াচ্ছে তার আনাচে কানাচে।

Pranticole
চরের ওপর প্রান্তে পায়ে পায়ে এগোতেই দেখা পেলাম এক জোড়া Rudy Shelduck আর অতি বিরল Osprey কে তার শিকার নিয়ে উড়ে যেতে।

Rudy Shelduck

Osprey with its catch

Purple Swamphen Flight
ফেরার পথে আবার দেখা হলো Purple Swamphen, Black headed Ibis এবং Lesser Whistling Duck এর সাথে…এখন তারা যেন আরও সপ্রতিভ। প্রায় ৬ ঘন্টা প্রানভরে চুপির চরের নির্যাস নিয়ে পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। ভাবতেও অবাক লাগে কত শত শত বছর ধরে বাংলার এই অতিথীরা ঠিক একই সময় এই একই জায়গায় তাদের অস্থায়ী আস্তানায় কত সহস্র মাইল অতিক্রম করে ঠিক রাস্তা চিনে চলে আসে!
“পরিযায়ী আবাস” এর জন্য যোগাযোগ: নবী বক্স অথবা সঞ্জয় সিংহ।
© Arijit Kar

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। তেমনই সুন্দর ছবিগুলো।
ধন্যবাদ আপনাকে
সুন্দর বর্ণনা আর ছবি। গ্রেট।
অসংখ্য ধন্যবাদ