১:
২০১৫ র সেপ্টেম্বর। পশ্চিম মেদিনীপুর নিয়ে গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়, Grand Canyon Of West Bengal. হ্যাঁ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রান্ড ক্যানিয়ন এ কোনোদিন যেতে পারবো কিনা জানিনা, তবে পশ্চিমবঙ্গের গ্রান্ড ক্যানিয়ন….গনগনি তে যাওয়া যেতেই পারে। সেপ্টেম্বরেরই শেষ শনিবারের আরণ্যক এক্সপ্রেসের একটি টিকিট কেটে নিলাম গড়বেতার।
২:
২৫ শে সেপ্টেম্বর শালিমার থেকে সকাল ৭.৪৫ এ আরণ্যক আমায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলো এক নতুন অভিযানের। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ আর গ্রাম বাংলার সবুজ দেখতে দেখতে ১১ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গড়বেতা। স্টেশন থেকে গনগনি ৪.২ কিমি। গড়বেতা স্টেশনের কাছেই কিছু হোটেল আছে। অটো ওয়ালা কে জিজ্ঞেস করে জানলাম গনগনি থেকে হাঁটা পথের মধ্যে একটি ছোট হোটেল আছে। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম সেই হোটেলে। সূর্য এখন একেবারে মধ্য গগনে। কাঠফাটা রোদ। এই সময়টা আর যাই হোক ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত নয়। তাই একেবারে বিকেলেই বেরুবো ঠিক করলাম।
৩:
ভাতঘুম যে অতি বিষম বস্তু, এইটা প্রথম টের পেলাম গনগনির এই হোটেলে। সূর্যাস্তের সময়টা হিসেব করে মোবাইল এর এলাম টা বৃথা গেল আমার snooze এর ঠেলায়। ঘুম ভেঙে দেখি সূর্যের পাটে যাওয়ার উপক্রম। এক নিঃশ্বাসে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে ক্যানিয়ন ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। খুব জোরে পা চালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। আকাশের গায়ে তখন শুধুমাত্র হালকা হয়ে আসা লাল আভা। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ক্যানিয়ন এর সাদা সাদা ল্যাটেরাইট গুলো যেন চকচক করছে। নিচ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে শিলাবতী।

Gangani at sundued lights of day end

Silabati river at sunset
ক্যানিয়ন এর রূপ ভোরের আলোয় কি হতে পারে, সেইটা আন্দাজ করতে করতেই কখন যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো বুঝতেই পারিনি। স্থানীয় কিছু কপোত কপোতী তখন পিকনিক স্পট থেকে উঠে, ফেরার পথে বাইকে করে। আমিও উঠলাম। ভাগ্যিস আরেকটা দিন হাতে আছে। ১০ মিনিটের রাস্তা হলেও, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। বেশ ভারী লাগলো অন্ধকার টা। এই রাস্তা দিয়েই একটু আগে এসেছি, অথচ এখন ঘন কালো অন্ধকারে চেনা রাস্তাটাই বড় অচেনা লাগছে। মোটরবাইক গুলো আগেই বেরিয়ে গেছে। বিদ্যুতের লেশ মাত্র নেই এদিকটায়। মনের ।মধ্যে একটা অজানা ভয় নিয়ে জোরে পা চালালাম। বড় রাস্তায় পরে তবে যেন অস্বস্তিটা কাটলো।
৪:
পরদিন আর ভুল করিনি। সকাল ৬.২০ তে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগেরদিন হন্তদন্ত হয়ে আসার সময় আশপাশ টা ভালো করে দেখা হয়নি। আজ ভোরের আলোতে ক্যানিয়ন যাবার রাস্তাটায় আসতেই মনটা ভরে গেল। দুপাশে আছে কাজুর বন। দুই মানুষ সমান উচুঁ সবুজ জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে লাল মাটির রাস্তা এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে গনগনির ক্যানিয়ন এর দিকে।

The red mud road towards Gangani canyon
ভোরের মিঠে আলোয় গনগনির রূপ একঝলক দেখেই বুঝে গেলাম কেন এটিকে Mini Grand Canyon বা Grand Canyon of West Bengal বলা হয়। ৭০ ফুট গভীর এই খাদ বা ক্যানিয়ন। নিচ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে শিলাবতী। প্রাকৃতিক নিয়মে বছরের পর বছর ধরে ভূমিক্ষয় এবং শিলাবতীর ছোঁয়ায় জন্ম নিয়েছে এই ক্যানিয়ন। খাদের গায়ে যেন কোনো শিল্পী ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে একেকটি ভাস্কর্য খোদাই করেছেন পাথরের গায়ে। ল্যাটেরাইট পাথরের ওপর যেভাবে ফুটে উঠেছে একেকটি মাস্টারপিস, তাতে সত্যি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে এগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই নিজে থেকে তৈরী হয়েছে। লাল মাটি আর পাথরের ওপর এখন ছড়িয়ে পড়েছে ভোরের রক্তিম আভা।

Gangani canyon beside Silabati river

Mini version of the Great Canyon

Rock structures

Laterite stone structures forming amazing shapes
বেলা বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে রঙের পরিবর্তন। আমার সামনের ক্যানভাসে আঁকা mini grand canyon তখন সোনালী আর লালের খেলায় মেতে উঠেছে। খাঁজে খাঁজে সবুজের ছোঁয়া। শিলাবতীর ওপারে দূর কোনো এক গ্রামে ধানক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। কুঁড়েঘরের সামনেই শরতের ছোঁয়া নিয়ে কাশফুলের বন নদীর ওপার থেকে এপার অব্দি চলে এসেছে।

Fertile lands on the other side of Silabati river
নদীর মাঝ বরাবর একটি চরে দাঁড়িয়ে কোনো এক জেলে থেকে থেকে তার জাল নিক্ষেপ করে চলেছে শিলাবতীর জলে।

Fishing in Silabati river
বেশ কয়েক ঘন্টা প্রকৃতির এই অসামান্য সৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে গেলাম। রোদের তাপ প্রখর হতে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ক্যানিয়ন এর ওপর থেকে শিলাবতীর পার অব্দি নামার জন্য সরকার সিঁড়ি বাধিয়ে দিয়েছে। নিচ অব্দি নেমে দেখি সে আরেক রূপ। আমার পেছনে বিশালাকার খাড়াই খাদ। নদীর পার বরাবর হাওয়ায় দুলছে কাশের বন।

Stairs down to Silabati river

Beautiful Kans at the footstep of Gangani

Kans flowers in the banks of Silabati river
গনগনির এই গ্রান্ড ক্যানিয়ন সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াও লোকমুখে প্রচলিত একটি ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের শিকড় পৌরাণিক যুগে মহাভারত অব্দি বিস্তৃত। পাণ্ডবরা বনবাসে থাকা কালীন এসে পড়েছিলেন এই গনগনি তে। এই তল্লাটে তখন দাপিয়ে বেড়াত বকাসুর নামের রাক্ষস। কোনো একজন গ্রামবাসীকে রোজ তার হাতে তুলে দিতে হত নৈবেদ্য হিসেবে। এর অন্যথা হলে, সমস্ত গ্রাম তছনছ করে ছাড়তো বকাসুর। পাণ্ডবরা এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। বকাসুরের খাদ্য হিসেবে উৎসর্গ হওয়ার জন্য একদিন সময় এলো এই পরিবারের। মাতা কুন্তীর নির্দেশে ভীম এই পরিবারের সদস্য হয়ে নিবেদিত হলো বকাসুরের কাছে। শুরু হলো প্রবল যুদ্ধ বকাসুরের সাথে শক্তিশালী ভীমের। অবশেষে ভীমের হাতেই বধ হলো বকাসুর। তাদের যুদ্ধের প্রতাপে এখানকার মাটি কেঁপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, আর তার থেকেই এই অদ্ভুত গনগনির ক্যানিয়ন এর সৃষ্টি।
৫:
বৈজ্ঞানিক না পৌরাণিক কোন তথ্যটি বেশি গ্রহণযোগ্য, এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। এবার ফেরার পালা। একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রজন্মের শিশুরা অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Grand Canyon এর কথা শুনেছে, বইয়ে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখেওছে। কিন্তু তারা বা বড়দেরও অনেকেই জানেন না গনগনির কথা। আকারে আয়তনে ছোট হতে পারে আমাদের গনগনি, কিন্তু সৌন্দর্যে কোনো অংশেই কম নয়। ভারতবর্ষের ভ্রমণ মানচিত্রে গনগনির কিন্তু একটা বড় জায়গা প্রাপ্য ছিল। তাই নয় কি?

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
excellent. i have seen Grand canyon. I feel like visiting Gangani, motibated by your excellent photography and account.
Thank you so much